ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র - মিখাইল বাকুনিন, ভাষান্তর- বি এ এস এফ

ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র - মিখাইল বাকুনিন

ভাষান্তর- বি এ এস এফ

অধ্যায় : এক

আসলে কারা সঠিক? ভাববাদীরা, না বস্তুবাদীরা? এরকম প্রশ্নে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকা চলবে না। আমাদের নি:সন্দেহে বলতে হবে যে ভাববাদীরাই ভুল এবং বস্তুবাদীরাই সঠিক। বস্তু এবং ভাব সম্পর্কে প্রুধো যেমনটি বলেছিলেনÑ “ভাব একটা ফুল, যেটার শেকড় আবার বস্তুবাদী অবস্থার মধ্যে নিহিত থাকে।” অর্থাৎ ঐ শেকড়টি ছাড়া ফুলের কোন অস্তিত্ব নেই। সেজন্য মানবতা, বুদ্ধিবৃত্তি, নৈতিকতা, রাজনীতি, সামাজিক বিষয়াবলী সবই তাদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটা প্রতিফলন। অর্থনীতিটাই এখানে শেকড় অর্থাৎ বস্তু। একে কেন্দ্র করেই রচিত হয় ভাব।

বস্তু আর ভাব না হয় বুঝলাম। কিন্তু মানবতা জিনিসটা কি আমরা বুঝি? এটা দিয়ে আসলে কী বুঝায়? মৌলিক বিজ্ঞানের সমস্ত শাখাসমূহ নিরপেক্ষভাবে এ মহান সত্যের সাথে সাথে একমত যে, মানবতা আসলে সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ উন্নয়নকেই বুঝায়। পৃথিবীর মানুষের ক্ষেত্রে আমাদের পশু প্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রকাশকেই মানবতা বলে। এটা ঠিক যে, যে উন্নয়নকে আমরা মানবতা বলছি সেটারও নেগেশন রয়েছে। মানবতা জিনিসটি এই নেগেশনকে প্রকাশ করে। যেটিকে আমরা বলি পশু প্রবৃত্তি। মানুষের মধ্যে এই নেগেশনটা একদিকে যেমন র্যারশনাল অন্যদিকে তেমনি প্রাকৃতিক। আশা করছি এই নেগেশনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। এবার আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি। অর্থাৎ ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র। শুরুটা বাইবেল দিয়েই করছি।

আমরা সবাই কম বেশি “বাইবেল” বইটির সাথে পরিচিত। বাইবেল বইটি বেশ মজাদার এবং একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বই। এটা আমাদের সব থেকে পুরনো মানব প্রজ্ঞার টিকে থাকার প্রমাণ। বাইবেলে খুব স্পষ্টভাবে নানান দু:খজনক মিথ পাওয়া যায়। বাইবেলের ঈশ্বর আসলে খুব ঈর্ষান্বিত, রক্তপিপাসু এবং হিং¯্র প্রকৃতির ছিলেন। তিনিই মূলত অ্যাডাম এবং ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন। আমরা নিশ্চয়ই অ্যাডাম এবং ইভের কথা শুনেছি। হ্যাঁ, আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ। অ্যাডাম ও ইভ কত আগে জন্মেছিলেন মনে আছে? যদি সঠিকভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলি অ্যাডাম এবং ইভ তারা গরিলা না হলেও গরিলার খুব নিকটবর্তী ছিলেন। তবে দুটি মূল্যবান গুণ থাকার কারণে অন্য প্রজাতির প্রাণীর চেয়ে তাদের অবস্থানটা একটু উপরে ছিল। গুণ দুটি ছিল- চিন্তার ক্ষমতা এবং বিদ্রোহের ইচ্ছা। এই দুটি গুণ ইতিহাসে তাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে একত্রিত করে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং মানুষের পশুত্বের ইতিবাচক উন্নয়নের নেগেশনকে প্রকাশ করে এবং ফলাফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে মানবতার সৃষ্টি করে।

তবে অ্যাডাম ও ইভকে সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের যে কী উদ্দেশ্য ছিল সেটা বোঝা যায় নি। তিনি নানান ধরনের প্রাণী এবং ফলের গাছ সহ অ্যাডাম এবং ইভকে পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু পাঠালেও ঈশ্বর তাদের একটা শর্ত দিয়েছিলেন। যে গাছটিতে জ্ঞান পাওয়া যায় সে গাছটির ফল খেতে তিনি তাদের নিষেদ করেন। তিনি চান নি মানুষ সব জ্ঞান লাভ করে ফেলুক। কিন্তু তখনই আবির্ভাব ঘটলো শয়তানের। এই শয়তানই ছিল সেই ইতিহাসের একজন বিদ্রোহী এবং প্রথম মুক্ত চিন্তক। কারণ সে-ই প্রথম ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে এবং জ্ঞানের ফলটি খেয়ে ফেলে।

তারপরে কি হয় আমরা অনেকেই হয়তো সে ঘটনা জানি। ঈশ্বর তখন শয়তানকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঈশ্বর শাস্তি দেন যে, “তুই এই অপরাধে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মাবি। তোর কোন মুক্তি হবে না।” আমাদের ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্ববিদরা আলোচনার সময় এই ঘটনা খুব সংক্ষেপে স্পর্শ করেন কারণ এটি একদিকে যেমন কিম্ভুতকিমাকার অন্যদিকে অন্যায়ও বটে। এতে ঈশ্বরকে মানুষ হিং¯্র হিসেবে দেখে। ধর্মতত্ত্ববিদরা মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করেন এটা ঈশ্বরের একটা রূপ মাত্র। তিনি কেবল প্রতিশোধ ও ক্রোধের ঈশ্বরই ছিলেন না, প্রেমেরও ঈশ্বর ছিলেন। তাদের ব্যাখ্যা মতে, কয়েক মিলিয়ন দরিদ্র মানুষের অস্তিত্ব ভোগ করার পর এবং তাদেরকে নরকে পাঠানোর পর ঈশ্বর কেন জানি হঠাৎ করে এই মানুষগুলোর প্রতি একটু দয়া বোধ করলেন। তখন তিনি তার একমাত্র পুত্র হিসেবে যীশুকে পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু কী এক পরিহাস এই পৃথিবীর মানুষগুলোই যীশুকে হত্যা করলো! তারপরেও যীশুর এই মৃত্যুটিই হলো খ্রিষ্টান ধর্মের রহস্যÑ মুক্তির রহস্য! আর এই রহস্যটাই খ্রিষ্টান ধর্মের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, ঐ ঐশ্বরিক পরিত্রাতা অর্থাৎ যীশু খ্রিষ্ট পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে পারেন নি। তিনি মানুষকে স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানকার সিট সংখ্যা তো সীমিত। আনুষ্টানিকভাবে নির্বাচিত কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউই তো সেখানে যেতে পারেন না। বাকী বিশাল সংখ্যার মানুষকে বার বার পৃথিবীতে আসতে হয় এবং নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাহলে সমাধানটা কি হলো? কিছুই না। বরং আমরা দেখি ঈশ্বরকেই এই পৃথিবীর দায়িত্বভার কখনো তৃতীয় নেপোলিয়ন, কখনো প্রথম উইলিয়াম, কখনো অস্ট্রিয়ার ফার্ডিন্যান্ড কখনো বা আলেকজান্ডারের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে ঈশ্বরের নিজেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

ক্যাথলিক প্রোটেস্ট্যান্ট সাধু সন্ন্যাসীরা উনিশ শতক জুড়ে এরকম উদ্ভট শিক্ষা প্রচার করে গিয়েছিলেন। ইউরোপের পাবলিক স্কুলগুলোতে সরকারের আদেশে এই শিক্ষাগুলো প্রচার করা হতো। তারা বলতো এর মাধ্যমে নাকি তারা মানুষকে সভ্য করছে! আদৌতে এটা ছিল ঢাহা মিথ্যাটার।

অথচ মজার ব্যাপার হলো, ঈশ্বর নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে শয়তান সঠিক ছিল। তিনি স্বীকার করেছিলেন জ্ঞান ও স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শয়তান অ্যাডাম এবং ইভের সাথে প্রতারণা করেনি। কিন্তু সে অ্যাডাম এবং ইভকে ঐ নিষিদ্ধ ফলটি গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছিল। এজন্য বাইবেলে ঈশ্বর বেচারা আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “শোনো, মানুষ ঈশ্বরের মত হয়ে গেছে। সে ভাল মন্দ সব জেনে গেছে। তাকে থামাও। নিষেদ করো ঐ ফলটি খেতে। নইলে সে আমাদের মত অবিনশ্বর হয়ে যাবে।”

এবার চলুন এই মিথের প্রকৃত সত্যটি বুঝি। মানুষ আসলে নিজেকে নিজেই মুক্ত করেছে। সে নিজেই তাকে পশুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সে এই ক্রমাগত অমান্য করে এবং অবাধ্য হয়েই নিজেকে উন্নত করেছে। এর জন্য তাকে সহায়তা নিতে হয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের। একটি চিন্তা এবং অন্যটি বিদ্রোহ। ঈশ্বর নামে কোন কিছু এখানে মানুষকে কোন সহায়তা করেনি।
এবার উন্নয়নের প্রসঙ্গে আসি। মূলত তিনটি উপাদানের উপর ভিত্তি করেই মানুষের উন্নয়ন বিচার করা যায়। হতে পারে তা ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক। উপাদান তিনটি হলো-
১.মানুষের পশু প্রবৃত্তি
২.চিন্তা
৩.বিদ্রোহ
এই তিনটির মধ্যে প্রথমটা সামাজিক এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত। দ্বিতীয়টা বিজ্ঞান এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত। এখন যদি কোন ভাববাদীকে তার মহান বুদ্ধিমত্তা, তার মহিমান্বিত চিন্তা, তার সীমাহীন আকাঙ্খা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তাহলে সবকিছুই তার কাছে নৈতিকভাবে ভুল কিংবা অপরাধসমান জিনিস ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সব ভাববাদীরাই এটাতে বিক্ষুদ্ধ হন। প্রশ্ন জিনিসটি তারা খুব একটা সহ্য করতে পারেন না।

বস্তুবাদীদের মতে, বস্তু স্বত:স্ফূর্ত এবং চিরকাল ধরে গতিশীল, সক্রিয় এবং বস্তু তার আভ্যন্তরীণ উপাদান দিয়েই গঠিত। কিন্তু উপাদান দিয়ে একটা বস্তু গঠিত হওয়ার বিষয়টি ভাববাদীদের কাছে নৈতিকভাবে একটা ভুল জিনিস! তারা এটাকে মানতে পারেন না। তাদের এই ভুল চিন্তার ফলাফলস্বরূপই পরে একটা স্টুপিড এবং কুৎসিত জিনিসের সৃষ্টি হয়। আর সেটিই হলো ঈশ্বর! যেটির সৃষ্টি হয়েছে বস্তুর ঠিক বিপরীতে গিয়ে। এই ঈশ্বর জিনিসটা সর্বোচ্চ অকর্মণ্যতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করে না। ঈশ্বরপন্থীরা তাদের এই ঈশ্বরকেন্দ্রিক চিন্তা দিয়ে মানুষের জীবন, বুদ্ধিমত্তা কেড়ে নিচ্ছে। যেগুলো দিয়ে আসলে বস্তুর মধ্যে গতির সঞ্চার হয় যেমন গতি সেটিকেও ঈশ্বরপন্থীরা কেড়ে নিচ্ছে। সকল ধরনের প্রাকৃতিক শক্তি, সম্পদ, সবকিছুকেই তারা তাদের বিমূর্ত শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। তারপর ঈশ্বরের ভূমিকাকে খানিকটা পরিবর্তন করে ঈশ্বরপন্থীরা ব্যাখ্যা করা শুরু করে যে ঈশ্বর আসলে কিছুই নন। তিনি কেবলই একজন শ্রেষ্ট জীব। তারা দাবি করে, ঈশ্বর নাকি ঘোষণা দিয়েছেন যে সত্যিকারের যা কিছু আমরা দেখছি, আমাদের পৃথিবী, বস্তু এগুলো আসলে কিছুই না। সব কিছুই নাকি ঐ ঈশ্বর দিয়েছেন। এমনকি বস্তুর মধ্যেকার গতিও। এভাবে ঈশ্বরপন্থীরা সমাজের মধ্যে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

একজন মানুষ যেসব কারণে ঈশ্বর সংক্রান্ত চিস্তা দ্বারা আক্রান্ত হয় বইটির শেষের দিকে আমি সেসব ফ্যালাসিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আসলে ঐ ফ্যালাসিগুলোই আমাদের ঈশ্বরকে এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কিংবা এরকম কিছু ভাবার দিকে ধাবিত করে। যে কারণে ঈশ্বর সত্ত্বাটিও সব সময় পৃথিবীতে বর্তমান থাকে, প্রভাব বিস্তার করে পুরো বস্তু জগত জুড়ে। এখন আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে শুরু করছি। সেটি হলো উন্নয়ন।
বস্তুজগত এবং প্রাণীজগতের এই যে ক্রমাগত উন্নয়ন এটি সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি। সরল থেকে জটিল, নিচু থেকে উঁচু, নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্ট এরকম স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়ায় এই উন্নয়নটি সম্পন্ন হয়েছে। এই উন্নয়ন অবশ্যই আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা, আমাদের মানসিকতা, বিশেষ করে সেরেব্রাল রিপ্রোডাকশন সিস্টেমের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন হয়েছে যার কারণে আমরা এতখানি উন্নত হয়েছি।

কিন্তু ভাববাদীরা এর ঠিক বিপরীতে যুক্তি করেন। অর্থাৎ মানুষের এই যে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই উন্নয়নটি সাধিত হলো এটি তারা মানতে চান না। তাদের অবস্থান এই চিন্তার ঠিক বিপরীতে। তারা ব্যাখ্যাটা এমনভাবে দাঁড় করান যেটি উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কিছু দাঁড়ায় না। এটি এতদিনকার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জটিল জিনিসকে সরল, উৎকৃষ্টকে নিকৃষ্ট, উচুঁকে নিচু এরকম করে ব্যাখ্যা করে। তারা শুরুই করে ঈশ্বর দিয়ে অর্থাৎ একটি ভয়ংকর পতনের মধ্য দিয়ে । তারা সবকিছুকে বস্তুর বাইরে নিয়ে যায়। মানুষ, জীব, জন্তু সব কিছুর অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করে। তারা পরিপূর্ণতাকে নিয়ে যায় অপরিপূর্ণতার দিকে। সমৃদ্ধ একটা জিনিসকে নিয়ে যায় শূণ্যতার দিকে। সঠিকতাকে নিয়ে যায় বেঠিকতার দিকে। আসলে কখন, কিভাবে এবং কেন এই ঐশ্বরিক, চিরন্তন, অসীম চিন্তাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এটা কোন ভাববাদী, ধর্মতত্¦বিদ, মেটাফিজিশিয়ান কেউই বুঝে ওঠা কিংবা ব্যাখ্যা করা কিছুই করতে পারেন নি। আর সব ধর্মই এরকম এককটি রহস্যের জালে আবৃত।

বিভিন্ন পবিত্র মানুষ, নবী, যীশুখ্রিষ্ট সবাই জীবনের জন্য এই ধর্মের অনুসন্ধান করে গেছেন। কিন্তু তারা যন্ত্রণা এবং মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই সেখানে খুঁজে পান নি। অনেকটা প্রাচীন স্ফিংক্স এর মত। মানুষ এটা নিয়ে আতঙ্কে থাকতো কারণ মানুষ তখন এটা সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানতো না। ঈশ্বর জিনিসটা অনেকটা এরকম। মানুষ এটা সম্পর্কে পরিষ্কার জানে না বলেই এটাকে ভয় পায় এবং বিশ্বাস করে। হেরাক্লিটাস এবং প্লেটো থেকে শুরু করে ডেসকার্টেস, লিবনিজ, কান্ট, ফিকটে, শিলিং, হেগেল, ভারতীয় দার্শনিক সবাই বিশাল বড় বড় ভলিউমের বই লিখেছেন। যেখানে তারা বিভিন্ন সুন্দর বিষয় এবং তাদের আবিষ্কৃত অবিনশ্বর সত্য সম্পর্কে বলেছেন। তবে লোকোত্তর অনুসন্ধানের যে প্রধান নীতি মানে “রহস্য” সেটিকে তারা পরিত্যাগ করেছেন। সেটি তারা স্পষ্ট করে যান নি। রহস্য শেষমেষ রহস্যই থেকে যায়। সিসিপাস অবশ্য তার অনুসন্ধানে দেখেছেন এই রহস্যের বিষয়টি আসলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এটি ভিত্তিহীন! তবে বিভিন্ন গোঁড়া শিষ্যের কারণে বিষয়টি আমাদের সামনে অনাবৃত থাকবে। কারণ তারা প্রত্যেক মানুষকেই তাদের চেতনা দিয়ে বিজ্ঞান থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং করবে।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে এই ভয়ংকর রহস্যটি অনির্বচনীয়। এটা কিম্ভুতকিমাকার। এই কারণেই কিম্ভুতকিমাকার যে এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এটাও স্পষ্ট যে, যে-ই এটার মধ্যে সুখ খুঁজে পায় তাকে অবশ্যই তখন যুক্তি পরিত্যাগ করতে হয়। তখন তার আলোচনা সমালোচনা সব ভেস্তে যায়। থেকে যায় কেবল ঐ স্টুপিড বিশ্বাস। এভাবেই একেকটা মানুষ এই স্টুপিড বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়।

কিন্তু এখানে সাথে সাথে আরেকটি প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়- “কিভাবে একজন বুদ্ধিমান মানুষ এই রহস্যে বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে?” প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক।
ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস খুব স্বাভাবিক বিষয়। এটা গ্রামের মানুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে শহরের প্রলেতারিয়েতদের তুলনায়। তবে কম বেশি দু জায়গাতেই এটি বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে, মানুষজন এখনো বঞ্চিত এবং বিভিন্ন উপায়ে সরকার তাদের বঞ্চিত করছে। কোন কারণ ছাড়াই তারা সরকারী বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে। প্রতিদিনের কাজের পর তাদের বিশ্রাম নেয়ার সময়টুকুও থাকে না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোটনা তো দূরের বিষয়। ঈশ্বরপন্থীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে। তারা এমন ভাবে এই ধর্মীয় চিন্তাটি মানুষের মধ্যে প্রচার করে যে কোন প্রকার সমালোচনা ছাড়াই মানুষ ধর্মীয় চিন্তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে। এই সংস্কৃতি ছোট বেলা থেকেই একটা শিশুর চারপাশে বিরাজিত থাকে এবং ধীরে ধীরে এটি তার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এক পর্যায়ে তা এসে অভ্যাসে পরিণত হয়।

এই বিশ্বাসের পেছনে অবশ্য আরো একটা কারণ আছে। ইউরোপের কিছু সভ্য দেশের কিছু অর্থনৈতিক সংগঠন মানুষকে এই উদ্ভট বিশ্বাসের জন্য মানুষকে মারাত্মকভাবে নিন্দা করে থাকে। সমাধানের বিপরীতে সব বুঝে শুনে তারা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। ফলে নিজেকে বুদ্ধিভিত্তিকভাবে, নৈতিকভাবে, সর্বোপরি বস্তুগতভাবে অনমন করে মানুষ নিজেকে জেলে বন্দী আসামীর মত মনে করে। তারা তখন ঈশ্বরকে আঁকড়ে বাঁচতে থাকে। এজন্যই এই অর্থনীতিবিদদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদি আমরা এই অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস করি তাহলে আমরা একটা সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যে বড় হবো এবং বুর্জোয়াদের থেকে কখনো নিজেদের মুক্ত করার চিন্তা করতে পারবো না। মুক্তির জন্য আমাদের সামনে সব মিলে তিনটি উপায় আছে। এর মধ্যে প্রথম দুইটা কাল্পনিক কিন্তু তৃতীয়তা বাস্তব। প্রথম দুইটা হল ড্রাম শপ এবং চার্চ। আর তৃতীয়টি হলো সমাজ বিপ্লব। যদি আমি তৃতীয়টি করি তাহলে এটা সব থেকে বেশি কার্যকরী হবে। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর নিষ্টুর উপভোগ দূর করতে একমাত্র সমাজ বিপ্লবই পারে ড্রাম শপ এবং এবং চার্চগুলো বন্ধ করে মুক্তির একটা সমাধান দিতে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতো মানুষকে এরকম নিন্দা করে দূরে ঠেলে দিলে তাতে কোন কাজ হবে না।

মনে রাখতে হবে, যদিও মানুষের এই বিশ্বাসের পেছনে কোন যুক্তি নেই তবুও পৃথিবীতে তাদের একটা অধিকার আছে। তাই মানুষকে এরকম দোষারোপ করা ঠিক না। আমাদের এই বিশ্বাসের মূল অনুসন্ধান করে তা উন্মোচন করা উচিত। এতেই কেবল সমাধান হতে পারে।

আমরা এই কাজটি করতে ব্যর্থ হলে তখন আবার একটা শ্রেণী জনগণকে বিশ্বাস করানোর জন্য ঈশ্বরের একটা রূপ তাদের সামনে উপস্থাপন করবে। তারা সকল পীড়ক, সকল নির্যাতক, সকল শোষক; যেমন- সাধু, সন্ন্যাসী, সৈনিক, অফিসিয়াল, পুলিশ সবাই ভলতেয়াররের বাক্যটির পুণরাবৃত্তি করবে- “ যদি ঈশ্বর না থাকে তাহলে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করো। মানুষের অবশ্যই একটা ধর্মের প্রয়োজন আছে।” কারণ এটা একটা সেফটি ভালভের মত। এভাবে তারা বলপূর্বক ঈশ্বরের আমদানি ঘটাবে।

অবশেষে অনেকেই এই খ্রিষ্টীয় ডগমাটি সিরিয়াসলি নেয়। কেউই আর এটাকে পরিত্যাগ করার আর সাহস করে না। যদি আপনি সমালোচনা করতে যান তারা আপনাকেও ধর্মের সমালোচনা করতে নিষেদ করবে। তারা সর্বত্র নাক উঁচিয়ে কথা বলবে। তাদের সেই কিম্ভুতকিমাকার চিন্তাকে তারা শক্তভাবে ভাবে আঁকড়ে ধরবে। তাদের ঈশ্বর কেবল বীর্যবান কিংবা ক্ষমতাশালী নন, তিনি নিষ্ঠুর ঈশ্বর। এটা এমনই এক নিষ্ঠুর সত্ত্বা যা একই সাথে আবছা, স্বচ্ছ এবং মায়াময়। শূণ্যেই এটি হারিয়ে যায়। এটা অনেকটা মরীচিকার মত যা কোন কিছু দূরীভূত করতে সহায়তা করে না। ঈশ্বরপন্থীরা এখনো বিশ্বাস করে ঈশ্বর শেষ হওয়ার সাথে সাথে সব শেষ হয়ে যাবে। তারা অনিশ্চিত, অসুস্থ আত্মায় আক্রান্ত। তারা বর্তমান সভ্যতার উপর তাদের মূল্যায়ন হারিয়েছে। তারা বর্তমান ভবিষ্যত কোনটির সাথেই নেই। তারা বুর্জোয়া এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মাঝামাঝি একটা স্থান ধারণ করে আছে। নিজের চিন্তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা কোনটাই তাদের নেই। তারা কেবল তাদের সময় নষ্ট করে। এদের এক কথায় “বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী” বলা যায়।

তাই তাদের নিয়ে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে তাই আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না। তারা আলোচনার মতো তেমন আহামরি কেউ নন। তবে এখানে কিছু মহান মানুষ আছেন আমাদের বেশির ভাগই যাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। তাদের জ্ঞানী মনে করেন। তাদের শক্ত মন, চিন্তা ভাবনা নিয়ে কেউই প্রশ্ন করার সাহস করেন না। খানিকটা সম্মানও করেন বটে। আমি এদের মধ্যে শুধু কয়েক জনের নাম উল্লেখ করছি- মাজজিনি, মিখিলেট, কুইনেট, জন স্টুয়ার্ট মিল। তারা সকলেই ভাববাদের প্রচারক। বস্তুবাদের কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা নিয়ে উপহাসও করেন যখন তখন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আমাকে অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে হবে।

আমি এখানে যাদের কথা বললাম তারা কখনোই যুক্তির দিকে খুব একটা নজর দেন নি। তাদের কেউই চিন্তাকে দার্শনিকভাবে স্থির করার চেষ্টা করেন নি। এজন্য তাদের প্রতি আমার প্রায়শই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করে যে, তারা কি দ্বন্দ্বগুলো দেখে ভয় পেতেন নাকি ইতিহাসে তাদের মত জিনিয়াসদের(!) ব্যর্থতার দিকে তাকিয়ে হতাশ হতেন? নাকি তারা মনে করেছিলেন যে তাদের চিন্তা যেহেতু সমাজে তারা পুঁতে দিয়েছে তাহলে ওসব যুক্তি টুক্তি এবার থাক? হতে পারে এটা তাদের গোপনীয় কিংবা ব্যক্তিগত কোন বিষয়। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে যে, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের তত্ত্বগত আলোচনার বিষয়টিকে অবহেলা করেছেন । এই অবহেলা করে যেটা তৈরি করেছেন সেটা হলো প্রায়োগিক এবং প্রভাবগত কিছু বিষয়। এটাই তাদের কাছে মুখ্য। তারা ধর্মকে এমনভাবে আকৃতি দিয়েছেন যাতে সারা বিশ্ব কোন যুক্তি ছাড়া এটি গ্রহণ করে। এভাবে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন প্রাচীন সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্ববাসীর বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়টিকেও। কিন্তু কেন? কারণ একটাই- ভয়! যুক্তির ভয়!

কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিওর আগে সবাই বিশ্বাস করতো যে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। সবাই কি তখন ভুল করে নি? দাস প্রথার থেকে প্রাচীন আর কি আছে? সম্ভবত নরমাংস ভক্ষণ প্রথা। তখন কি মানুষ ভুল করে নি? মোদ্দাকথা, ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পর্যন্ত সব জায়গায়ই শ্রম শোষণ হচ্ছে। কখনো দাস হিসেবে, কখনো ভূমিদাস হিসেবে, কখনো মজুর, কখনো শ্রমিক হিসেবে এ শোষণ চলছেই। চার্চ মানুষকে নিপীড়ন করছে, নিপীড়ন করছে রাষ্ট্রও। যারা করছে তারা আবার সমাজের সংখ্যালঘু। তাহলে কি এই শোষণ এবং নিপীড়ন প্রত্যেক সমাজই তার উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করলো? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ঈশ্বরকে চ্যাম্পিয়ন করে লাভটা কি হলো?
আসলে সত্য এবং ন্যায়বিচারই হচ্ছে ইউনিভার্সাল বিষয়। এটাই মানুষের উন্নয়নের সবচেয়ে জীবন্ত বৈশিষ্ট্য। এটি প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্য অনেককেই অনেক শাস্তি বরণ করতে হয়েছিল (ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা তো আমরা সবাই জানি)। মানুষও এই সত্য প্রচারকদের কম নির্যাতন করে নি। কিন্তু শেষ মেষ দেখা যায় এক পর্যায়ে এসে মানুষই তাদের চিন্তা গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।

আমাদের বিবেকের দৃঢ়তা, সত্যের প্রতি ভালবাসা, যুক্তির মত শক্তিশালী জিনিসের উপর আবেগ, ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগ এবং মানবতার প্রতি আমাদের অফুরন্ত বিশ্বাস এসবের মাধ্যমে আমরা ঐতিহাসিক সকল ঘটনার প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি। মুক্ত করে আমরা সৃষ্টি করেছি সামাজিক আইন, প্রাকৃতিক আইন সহ অন্যান্য আইন যা পৃথিবীকে পরিচালনা করছে।

এই আইনটি যুক্তি সম্মত এবং এটা মানব সমাজে পশু প্রবৃত্তি সৃষ্টির ফলাফল। জার্মানদের ফ্রান্স দখল সহ আরো অনেক ঘটনা এর চাক্ষুষ প্রমাণ। এই পশু প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করার সাথে সাথেই ইতিহাস আমাদের কাছে একটি বিপ্লবী নেগেশন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। মানুষ আজ সেই বন্য পশু, সেই গরিলার বংশধর থেকে, পশুত্বের অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখেছে। তবে আলোর মুখ দেখলেও মানুষ এখন নতুন দাসত্বের স্বীকার। তারা এখন পশুত্বের দাসত্ব থেকে বের হয়ে ঐশ্বরিক দাসত্বের কবলে পড়েছে। এটা পশুত্ব এবং মানবিকতার মাঝামাঝি একটি স্তর। মানুষকে তাই এখনো ছুটতে হচ্ছে মানব মুক্তির পানে। আমাদের পেছনে পশুত্ব এবং সামনে মানবতা। এই মানবতাই একমাত্র জিনিস যেটা আমাদের আলোকিত করতে পারে। একমাত্র জিনিস যেটা আমাদের মুক্ত করতে পারে। আমাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সুখ সব দিতে পারে।

তাই কখনো পেছনে তাকানো চলবে না। চলুন, সামনে তাকাই। সামনে আলো, সামনেই মুক্তি। সামনে তাকাতে হবে এজন্যই যাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের কি আছে এবং কি হওয়া উচিত। আমাদের কি বিশ্বাস করা উচিত এবং কি নয়। আমরা কি করবো এবং কি করবো না। ইত্যাদি।

যেহেতু এটা এখন প্রতিষ্টিত যে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এর মাধ্যমে আমরা কেবল এই উপসংহারে পৌঁছতে পারি যে, ঐশ্বরিক ধারণা এক ধরনের ভ্রান্তি যেটা মানুষ তার উন্নয়নের জন্য আজ প্রয়োজনীয় মনে করছে। এখন আমাদের প্রশ্ন করা উচিত, কেন এটা ইতিহাসের পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়েছে? এবং কেন পৃথিবীর বড় একটা অংশ সত্য হিসেবে এটাকে গ্রহণ করছে?

আমাদের সব সময় ভাবতে হবে যে কিভাবে এই আধ্যাত্মিক চিন্তাগুলো বিকাশ লাভ করলো। এটা করতে না পারলে আমাদের সব বৈজ্ঞানিক অর্জন ভেস্তে যাবে। এটা ছাড়া আমরা কখনো সংখ্যাগরিষ্টের মতামতকে যেমন ধ্বংস করতে পারবো না তেমনি এটাকে গভীর থেকে আক্রমণও করতে পারবো না। এজন্য আমাদের প্রাণপণে এই সংগ্রামটা করা উচিত। এটা ভাবলে ভুল হবে যে এই অদ্ভুত চিন্তা, ঈশ্বরে বিশ্বাস এগুলো সমাজে ডালপালা গজাবে না। অবশ্যই গজাবে। আমরা কিছু না করলে আজ এই যুগে এসেও খ্রিষ্টান ধর্মের ধ্বংসস্তুপে উপর দাঁড়িয়েও এসব চিন্তÍা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এখানে যে কেবল জনগণের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বিষয়টা সেরকম নয়। আমাদের মানসিক শান্তির জন্যও এটা করা দরকার। আমাদের এই ঐতিহাসিক জেনেসিস, ঈশ্বরের ধারণার বিকাশ এবং এর কারণ এগুলো সম্পর্কে বুঝতে হবে। না পারলে দেখা যাবে আমরা কেবল নিজেদের নাস্তিক দাবি করে বসে আছি। কিন্তু কখনো সেই সত্যটিকে বের করতে পারবো না। মনে রাখতে হবে আমরা সব সময় একটা হুমকির মধ্যে আছিÑ ধর্মীয় কিম্ভুতকিমারদের দ্বারা আমাদের স্থান হারানোর হুমকি। এসব হুমকি বিভিন্ন জায়গায় কার্যকরও হচ্ছে। তাই প্রকৃত সত্যকে উন্মোচন করার কোন বিকল্প এখানে নেই।

অধ্যায় : দুই

আমি ইতোপূর্বে বলেছি যে, জনতার মাঝে আজ অবধি যে ক্ষমতার চর্চা চলে এসেছে তার বাস্তব ভিত্তি মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস। হৃদয়ের অসন্তোষ থেকে মানুষের মনের যে বিকার সৃষ্টি হয় তাতেই এই রহস্যময় আচরণগুলো মানুষের মাঝে ঝেঁকে বসে। নিজেদের সকল প্রকার সংকীর্ণতা, বালখিল্যতা, জরাগ্রস্থতা এবং হতভাগ্য অস্তিত্বের লজ্জার বিরুদ্ধে এই বিশ্বাসগুলো যেন মানুষের দৃঢ় এবং সহজাত প্রতিরোধ। আমি আগেই বলেছি, এই ব্যাধির একটাই মহাষৌধÑ সামাজিক বিপ্লব।

এজন্য আমি মানুষের চিন্তার মধ্যে এই ধর্মীয় বিভ্রম সৃষ্টি এবং এর ক্রমবিকাশের কারণগুলো খুঁজে বের করে আপনাদের দেখাবো। এখানে প্রথমেই আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিংবা মানুষের এই পৃথিবীর দৈব উৎপত্তির প্রশ্নে। এই দৈবত্বের নৈতিক ও সামাজিক উপযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি কয়েকটি কিছু কথা বলবো। কথাগুলো এই বিশ্বাসের তত্ত্বগত ভিত্তির বুনিয়াদের উপর আমার চিন্তাধারাকে প্রকাশ করবে।

সকল ধর্ম, একই সাথে তাদের দেবতা, উপ দেবতা, নবী, মশীহ এবং সাধুসন্তদের সৃষ্টি হয়েছে সেই সমস্ত মানুষদের বিশ্বাস প্রবণ কল্পনা শক্তির দ্বারা যাদের এখনো পরিপূর্ণ বিকাশ হয় নি। এসব মানুষ তাদের কর্মক্ষমতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে নি। নিয়ন্ত্রণ নাই বলেই এসব অশুভ চিন্তার বিকাশ ঘটছে। কাজেই ধর্মীয় স্বর্গ আদৌতে মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়। সেখানে অজ্ঞতা এবং বিশ্বাসের গৌরবে গৌরবান্বিত মানুষগুলো বৃহৎ পরিসরে তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পায়। বিনিময়ে যা পায় তা হলো- স্বর্গীয় প্রতারণা। ধর্মের ইতিহাস এবং মানুষের বিশ্বাস একের পর এক জাঁকিয়ে বসা দেবতাদের উত্থান, প্রতিষ্ঠা এবং পতন মানবজাতির সামগ্রিক বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তাকাঠামোর উন্নতি ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় মানুষ যখন তাদের নিজেদের সত্ত্বা আবিষ্কার করতে শুরু করলো কিংবা প্রকৃতির নিয়মগুলোকে বুঝতে শুরু করলো তখনই শিশুসুলভ ভঙ্গিমায় তারা সে ক্ষমতা, তাদের কোন গুণ বা দোষ যেটাই হোক সব কিছুকে ধর্মীয় উন্মাদনায় ঈশ্বরের দান ভাবতে শুরু করলো। ধর্মচারী এবং বিশ্বাসী মানুষদের ঈশ্বরের প্রতি এই ভক্তি এবং বিনয়কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বিশেষ করে স্বর্গ নামক কাল্পনিক জিনিসকে জমকালো করে উপস্থাপনের জন্য। তাদের এ সমস্ত বিশ্বাসে পৃথিবী যত বেশী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছিলো স্বর্গের প্রাচুর্য ততই ফুলে ফেঁপে উঠছিল। অন্যদিকে স্বর্গের দেবতাদের ভাগ্য যত ফুল-চন্দন জুটছিল, মানবতা এবং পৃথিবী ততই হতভাগ্য হচ্ছিলো।
একটা সময় এসে মানুষজন ঈশ্বরকে পৃথিবী নামক যন্ত্রে ইনস্টল করে। ধীরে ধীরে অতি স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বর নিজেকে সকল ঘটনার কারণ, সর্বশক্তিমান এবং পরম নিয়ন্তা হিসেবে দাবী করে বসলেন। অতঃপর পৃথিবীর আর কিছুই রইলো না। ঈশ্বরই হয়ে উঠলেন সব; এবং তার ¯্রষ্টা মানে মানুষ, যারা ঈশ্বরকে অজান্তে শূণ্য থেকে এক সময় যাকে আমদানি করেছিল, তারাই ঈশ্বরের সামনে মাথা নত করলো। তারা ঈশ্বরের তরে নিজেদের সঁপে দিল এবং নিজেদের ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের দাস হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলো ।

অন্য সকল ধর্মের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্ম তার উৎকর্ষের দিক থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। কারণ এটি সর্বতোক্রমে সকল ধর্মের সারমর্মকে এক সাথে চিত্রিত করে প্রচারে এনেছে। সেই প্রচারের বিষয়বস্তু আর কিছুই না- স্বর্গীয় দৈবত্বের বদৌলতে মানবতার দারিদ্রতা, দাসত্ব এবং বিনাশ।

তাদের মতে, ঈশ্বর হলেন সমস্ত কিছু। এই জগত এবং মানুষ কিছুই নয়। ঈশ্বর হলেন সত্য, ন্যায়বিচার, উৎকর্ষ, সৌন্দর্য, শক্তি এবং জীবনের প্রতীক। পক্ষান্তরে মানুষ হলো মিথ্যা, অপরাধ, মন্দ, কর্দমতা, দুর্বলতা এবং মৃত্যুর প্রতীক। ঈশ্বর হলেন প্রভু, মানুষ তার দাস। নিজের চেষ্টার দ্বারা মানুষ ন্যায় বিচার, সত্য এবং আত্মিক জীবনের সন্ধান পেতে অপারগ। কেবল মাত্র ঈশ্বরের দৈববাণীর মাধ্যমেই মানুষ এগুলো লাভ করতে পারে। যারা এই দৈববাণী প্রচার করবে তাদের ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত হতে হবে এবং তারা অবতার, মশীহ, নবী, পুরোহিত এবং বিধানকর্তা নামে পরিচিত হবেন। আর এভাবেই একবার পৃথিবীতে দেবতাদের প্রতিনিধি এবং মানবতার পবিত্র পথনির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর, মানবজাতির উদ্ধার কাজে ঈশ্বর কর্তৃক নিয়োজিত হবার পর, তারা পৃথিবীতে পরম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান। প্রত্যেক মানুষই পরোক্ষভাবে তাদের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য প্রকাশের জন্য বাধ্য থাকে। ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতিরেকে তখন মানুষের কোন ইচ্ছা থাকে না। ঈশ্বরের বিচারের বাহিরে তখন পৃথিবীর মানুষের কোন বিচারও ফলপ্রসু হয় না। ঈশ্বরের দাস হবার সাথে সাথে মানুষকে চার্চ এবং রাষ্ট্রেরও দাস হতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের উপরে চার্চের আধিপত্য থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই দাসত্বও বলবৎ থাকে।

খ্রিষ্টধর্ম এটি বুঝতে পেরেছিল যে, প্রাচীন মহাদেশীয় ধর্মগুলোর মত কেবলমাত্র স্বতস্ত্র এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতিগুলোর দিকে নজর দিলেই হবে না। তাই খ্রিষ্ট ধর্ম আরো উচ্চ বিলাসী হয়ে সমস্ত মানবতাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। এটি শুধু নির্দিষ্ট মহাদেশে নয়, দুনিয়া জুড়ে কঠোর ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই কারণে খ্রিষ্ট ধর্ম একমাত্র পরম ধর্ম, সর্বশেষ ধর্ম। এ কারণেই ভাববাদী ধারায় পুষ্ট রোমান ক্যাথলিক চার্চই একমাত্র সঙ্গতিপূর্ণ, বৈধ এবং দৈব আশির্বাদপুষ্ট চার্চ। আর সব নাকি মিথ্যা!

সকল অধিবিদ্যাবিদ এবং ভাববাদী দার্শনিক, রাজনীতিবিদ কিংবা কবিদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি; ঈশ্বরের ধারণা মনুষ্য সমাজের কারণ ও বিচারের ধারণাকে অস্বীকার করে। এই ধারণা মানুষের স্বাধীনতার বিপরীতে অবস্থান করে এবং প্রয়োজনীয়ভাবেই তত্ত্ব এবং প্রয়োগগত উভয় অর্থেই মানুষকে দাসত্ব বরণ করানোর মধ্য দিয়েই কেবল এর অবসান ঘটে। একারণে আমরা মানুষের দাসত্ব এবং পতনের আশা করতে পারি না। যেমনটা আশা করেন মমাইরস, প্রাইটিস্ট কিংবা প্রোটেস্ট্যান্ট মেথডিস্টদের মত ভন্ড ব্যক্তিরা। কিন্তু আমরা সেটা পারবো না, কোনো ভাবেই না। এমনকি ধর্মতত্ত্বের ঈশ্বর কিংবা অধিবিদ্যার ঈশ্বর কাউকেই যৎসামান্য অনুমোদনও আমরা দিতে পারবো না। যেমনভাবে ইংরেজি অক্ষর অ দিয়ে শুরু হলে সেটা অনিবার্যভাবেই ত দিয়ে সমাপ্ত হয়। ঠিক সেরকমই যিনি ঈশ্বরের অর্চনা করতে চান তাকে কেবল শিশু সুলভভাবে এই বিভ্রমগুলোর কাছে আশ্রয় নিলে চলবে না, দ্ব্যর্থকণ্ঠে তার স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করতে হবে।

যদি ঈশ্বর থাকেন তবে মানুষ হবে দাস। তাহলে মানুষের মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হলো ঈশ্বর না থাকা। এই চক্রকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। তাই আমাদের সবাইকে এই দুটি পথের যেকোন একটিকে বেছে নিতে হবে। হয় ঈশ্বরকে স্বীকার করা, নয়তো অস্বীকার করা। স্বীকার করলে আমরা ঈশ্বরের দাস, অস্বীকার করলে আমরা মুক্ত।

এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ধর্মীয় রীতিনীতি মানুষকে অধঃপতিত ও নীতিভ্রষ্ট করেছে কিনা? করলে কি পরিমাণে করছে? এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা কী খুব জরুরি? হ্যাঁ, জরুরি। কারণ এই রীতিনীতিগুলো মানুষের কার্যকারণ অনুসন্ধানের ক্ষমতাকে নষ্ট করছে। এগুলো মানুষের মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়। এই রীতিনীতিগুলো মানুষকে ক্ষীণ বুদ্ধির অধিকারী করে তাদেরকে তথাকথিত ঈশ্বরের দাস বানিয়েছে। ধর্মবাদীরা মানুষের শ্রমকে অসম্মান করে সেটাকে ঈশ্বরের প্রতি বশ্যতার প্রতীক হিসেবে দেখে। মানুষের বিচার করার সক্ষমতাকে এগুলো গলা টিপে হত্যা করেছে। সর্বদা এই ধর্মীয় উন্মাদগুলো বিজয়ী দুর্বৃত্তদের পক্ষ নিয়েছে। বিনিময়ে পেয়েছে স্বর্গীয় জীবনের মতই বিশেষ সুবিধা। মানুষের সম্মান এবং মর্যাদাকে খুন করে তারা কেবল মাত্র বিনয়ী চাটুকাদের রক্ষার মহান দায়িত্ব নিয়েছে। এই দুর্বৃত্তদের দল প্রতিটি জাতির মান মানুষের মধ্যে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নষ্ট করে মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে স্বর্গীয় নিষ্ঠুরতা।

আসলে প্রতিটি ধর্মই এরকম নিষ্টুর রক্তগঙ্গার উপর প্রতিষ্টিত। ত্যাগের মহিমার কথা বলে তারা ভন্ডামি করে। স্বর্গের বাসনা দেখিয়ে তারা মানবতাকে বলি দেয়। তাদের ধর্মের এই রক্তের হোলি খেলাতে মানুষ সর্বদাই বলি হয়। অন্যদিকে পুরোহিত নিজে একজন মানুষ হয়েও সৌভাগ্যবশত ঈশ্বরের কৃপাধন্য হয়ে পরিণত হয় সুবিধাবাদী স্বর্গীয় জল্লাদে। এই পৃথিবীতেই সে পায় স্বর্গীয় সুখ আর মানুষ পায় হাহাকার।

এই ঘটনার দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, কেন সকল ধর্মের পুরোহিতেরা সর্বোত্তম গুণের অধিকারী? কেন তারা সবচেয়ে বেশি ভদ্র? কেন তারা সব সময় ঈশ্বরের হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করেন? কারণ যদি তাদের হৃদয়ে, তাদের চিন্তা চেতনায়, তাদের মনে ঈশ্বর না থাকেন তাহলে তারা এ সমস্ত ভন্ডামির কোন ব্যাখ্যা হাজির করতে পারবেন না (কারণ আমরা জানি সাধারণ মানুষই হোক আর পুরোহিতই হোক দুজনেরই হৃদয় আলাদা নয়)। এজন্য নিজের মনের মধ্যে ঈশ্বরকে ধারণ করে তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের জাহির করেন। এভাবে ঈশ্বরকে সামনে রেখে তারা রক্তক্ষয়ী ও পাশবিক ঘটনাগুলো ঘটায়। যেটির জন্য পুরোহিতের হৃদয় প্রকারান্তে ঈশ্বরের হৃদয়ই দায়ী।
এই সমস্ত ছল চাতুরি আমাদের সমসাময়িক উন্মাদ ভাববাদীদের চেয়ে কেউই ভাল জানে না। তারা এমনই শিক্ষিত লোক যে ইতিহাসকে তারা জানার চেষ্টা করে হৃদয় দিয়ে! এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে! তারা তাদের অসাধারণ বাগ্মিতা দিয়ে ধর্মের সমস্ত অপকর্ম, সমস্ত অপরাধগুলো আমাদের কাছে জায়েজ করে। মানুষের সত্যিকারের মঙ্গলের জন্য যে ঈশ্বরের (মানে বিজ্ঞানকে বুঝানো হচ্ছে) প্রয়োজন এই বক ধার্মিকরা সম্মিলিতভাবে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।

মানুষ যে ঈশ্বরের তারা পূজা করে কিংবা পূজা করার চিন্তা করে, তা ঐতিহাসিক ধারায় যে আসল ঈশ্বর আসার কথা ছিল (মানে বিজ্ঞান) সেটা থেকে ভিন্ন। তার মানে হচ্ছে ধর্মতাত্ত্বিক কিংবা অধিবিদ্যিক যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন তাদের প্রজিত ঈশ্বর আসলে ঈশ্বর নন। এই ঈশ্বরকে রোবেসপিরি কিংবা জে জে রুশোর চরম সত্ত্বাও বলা যায় না। কিংবা স্পিনোজারের সর্বশ্বেরবাদী ঈশ্বর বলেও আখ্যা দেয়া যায় না। আবার এই ঈশ্বর পূর্বে বর্ণিত হেগেলের অন্তর্যামী, অতিন্দ্রিয় এবং সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত বলেও ধরে নেয়া যায় না। ধর্মবাদীরা তাদের ঈশ্বরকে কোন সংজ্ঞার আওতাধীনে ফেলতে চান না। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ঈশ্বরের কোন সংজ্ঞা দিলে তিনি নিন্দুকের সমালোচনার মুখে পড়ে যেতে পারেন। তারা এটাও বলতে চান না যে এই ঈশ্বর তাদের ব্যক্তিগত না সার্বজনীন। ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন কি করেন নি এ ব্যাপারেও তাদের মুখ বন্ধ থাকে। ঈশ্বরের দৈব দূরদর্শিতার ব্যাপারেও তারা কথা বলতে নারাজ। তারা হয়তো মনে করেন এগুলো নিয়ে আলাপ করা ঈশ্বরকে ছোট করার সমান। তারা শুধুমাত্র “ঈশ্বর” শব্দটি বলার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চান এবং আর কোন কিছুই বলতে চান না। কিন্তু তারপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়ায় তাদের ঈশ্বর আসলে কী? তাদের ঈশ্বর একটি ধারণা মাত্র নয়; এই ঈশ্বর মানুষের একটা বিমূর্ত উচ্চাকাঙ্খা।

যা কিছু মহৎ, ভালো, সুন্দর, অভিজাত, মানবিক তার মধ্যেই ধর্মবাদীদের মতে ঈশ্বরের প্রকাশ। কিন্তু কেন? তারা কি মানুষ দেখে অভিভূত হয় না? মানুষের মধ্যে কি ভালো সুন্দর কিছু নেই? প্রুশিয়ার স¤্রাট উইলিয়াম, ৩য় নেপোলিয়ন এবং তাদের সমবয়সীরা মানুষের মতই দেখতে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ধর্মবাদীদের ভাবনার কারণ হন কেন? আর ঈশ্বর সব ভালো কিছুতেই থাকেন কেন? খারাপে কি সমস্যা? মানবতা তো সকল প্রকার আমিত্বের সমন্বয়। সেখানে যেমন থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং মহিমান্বিত জিনিসগুলো, তেমনি থাকে সবচেয়ে ভয়ংকর এবং জঘণ্য জিনিসগুলোও। ধর্মবাদীরা কি আদৌ এগুলো অতিক্রম করতে পারে? কেন তারা একটিকে পুতপবিত্র এবং অন্যটিকে বীভৎস ভাবে? কোন উত্তর নেই। ফলাফলস্বরুপ যা হবার তাই হয়। পবিত্রতা এবং বর্বরতাকে সেতুর দুইপ্রান্তে রেখে মাঝখানে তারা স্থান দেয় মানবতাকে। তারা এটি বুঝতে পারে না কিংবা বুঝতে চায়ই না তিনটি এক এবং অভিন্ন। ফলে তারা এই তিনটিকে কাটাকাটি করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। কী বীভৎস!

তাদের কেউই যুক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী নন। হয়তো অনেকেই বলতে পারেন তাদের এটার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাদের এই যুক্তিহীনতাই তাদেরকে সর্বেশ্বরবাদী আধিবিদ্যকদের থেকে পার্থক্য গড়ে দেয় এবং তাদের চিন্তাকে গোঁড়া ভাববাদী করে তোলে। চিন্তা গড়ে উঠার ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে তাদের ভাবনাগুলোর গোড়াপত্তন হয়। আবেগ, ইতিহাস, সমগ্রতা কিংবা জীবন সকল ক্ষেত্রেই তাদের এই চিন্তা পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের দৃষ্টিতে দৈবভাবেই সম্পদ এবং ক্ষমতা মানুষের কুক্ষিগত হয়। তাদের এই আবির্ভূত চিন্তা যখন যুক্তির বেড়াজালে পড়ে তখন তা নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

তাদের চিন্তাগত দ্বন্দ্ব খানিকটা এরকম- তারা ঈশ্বরকে প্রত্যাশা করে আবার তারা মানুষকেও চায়। তারা এমন দুইটি ধারণাকে সংযুক্ত করতে চায়, যারা একে অপরকে ধ্বংস করা ছাড়া নিজের প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম নয়। তাদের এক নিঃশ্বাসে বলতে শোনা যায়-“ঈশ্বরকেই চাই, সাথে চাই মানুষের মুক্তি”, “ঈশ্বরকেই চাই এবং সাথে চাই মানুষের জন্য সম্মান, ন্যায়বিচার, সাম্য, সৌহার্দ এবং সমৃদ্ধি”Ñ গুণের মানদন্ডে এই ভয়ংকর যুক্তিকে বিচার করলে যেটা দাঁড়ায় তা হলো, যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে অন্য সবগুলোই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যায় কিংবা সবগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। ইতিহাসের সমস্ত শিক্ষা এবং কান্ড জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে তারা এটা বলতে চায়, তাদের কথিত ঈশ্বর মানুষের মুক্তির ¯েœহবৎসল পিতা: যিনি কিনা নিজেই প্রভু। আর মানুষ কিছুই না। অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বের মানেই হলো তার নিচে যারাই আছে সবার দাসত্ব। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকলে মানুষের মুক্তি অসম্ভব। তাই এই অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়াই আমাদের কর্তব্য।

মানুষের মুক্তির একজন হিংসাপরায়ণ প্রেমিক হিসেবে এবং মানবতার পরম অবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে আমি ভলতেয়ারের প্রবাদটি আবারো বলতে চাই, “যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকেই, তবে অচিরেই তাকে বাতিল বলে ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে।” এটি অনিবার্য। কারণ এটি ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই।

তীব্র যুক্তিপূর্ণ এই কথাগুলো আরো আধুনিকীকরণ করতে হবে বলে আমি মনে করি। যুক্তির পরকাষ্ঠায় নিজেদের আসীন করতে হবে। তাহলে ধর্মবাদীরা আর উৎফুল্ল হওয়ার সুযোগ পাবে না। তারা মানুষের মুক্তির এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এই দ্বন্দ্বগুলো একত্র করতে গিয়ে আর মোহের ঘূর্ণিচক্রে আবর্তিত হবে না।

অবশ্য ধর্মবাদীরাও কিন্তু সম্মান এবং ভালোবাসার সাথে মানুষের মুক্তির কথা বলে। সেটা আমাদের মত বস্তুবাদী এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের মানুষের মুক্তি সংক্রান্ত ভাবনা থেকে অনেকটা ভিন্ন। কারণ তারা যখনই মুক্তির প্রসঙ্গটি আনে সাথে সাথেই তারা আরো একটি জিনিস সেখানে যুক্ত করে, তা হলো মুক্তি দানকারী কর্তৃপক্ষের কথা। সে কর্তৃপক্ষকে আমরা সমস্ত হৃদয় দিয়ে প্রত্যাখ্যান করি। প্রকৃতিতে আবার কর্তৃপক্ষ কিসের? কোন কর্তৃপক্ষ কী প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? প্রকৃতি তো একটা সিস্টেমেটিক বিষয়। কোনো কর্তৃপক্ষই একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির এই নিয়মগুলোর সাথে বিদ্রোহ দেখানো শুধু নিষিদ্ধই নয়- এটা আমাদের পক্ষে অসম্ভবও বটে। আমরা এই নিয়মগুলো সম্বন্ধে ভুল জানতে পারি কিংবা কিছুই না জানতে পারি, কিন্তু এগুলোকে আমরা অসম্মান করতে পারি না- কারণ এগুলো আমাদের অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তি গড়ে দেয়। এগুলো আমাদের আচ্ছাদন করে। আমাদের সত্ত্বার ভেতরে প্রবেশ করে। আমাদের সমস্ত গতিবিধি, চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে; এমনকি যখন আমরা মনে করি যে এগুলোকে আমরা মানি, তখনো আমরা সব জায়গায় এই জিনিসগুলোকেই দেখতে পাই।
হ্যাঁ, আমরা আসলে এই নিয়মগুলোরই গোলাম। যেকোন প্রকারের দাসত্বের বাহিরের একজন মনিব থাকে- যার আদেশে ব্যক্তির সমস্ত আইন নির্ধারিত হয়। কিন্তু এই নিয়মগুলো আমাদের কাছে বাহিরের কোন কিছু না; এগুলো আমাদের সহজাত, এগুলো দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সর্বোপরি নৈতিকভাবে আমাদের পূর্ণ সত্তা গঠন করে। এই নিয়মগুলোর দ্বারাই আমরা বাঁচতে পারি, নিঃশ্বাস নিতে পারি, কাজ করতে পারি, চিন্তা করতে পারি, নিজের ইচ্ছার কথা অন্যকে জানান দিতে পারি। এগুলো ছাড়া আমরা কিছুই না, আমরা হয়ে পড়ি অস্তিত্বহীন।

প্রকৃতির নিয়মগুলোর সাথে আমাদের এই নিবিড় সম্পর্কের কারণ কেবল মাত্র একটিই- সেটা হচ্ছে ব্যক্তিক এবং সামগ্রিক মুক্তির লক্ষ্যে কিংবা মানবতার মহান উদ্দেশ্যে এই নিয়মগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে প্রয়োগ করা। এই নিয়মগুলো একবার চিহ্নিত করা গেলে এর ব্যবহার নিয়ে মানুষের মাঝে কখনো বিতর্কের সৃষ্টি হয় না। তবে একজন স্থূল বুদ্ধির মানুষ, একজন ধর্মতাত্ত্বিক কিংবা একজন অধিবিদ্যাবিদ, নয়তো একজন আইনজ্ঞ কিংবা বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ, তারা দুই দুগুণে চারের মত সরল এই নিয়মগুলো মানতে চাইবেন না। সেজন্য তারা ইতিহাসের তলায় ঠাঁই পাবেন।

এজন্য কোন মানুষ যখন বিশ্বাসী হন, তখন তিনি ভাবেন যে আগুন হয়তো পোড়াবে না কিংবা পানিতে হয়তো মানুষ ভিজবে না। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে তখন বিশ্বাসই হয় তার শেষ অস্ত্র। কিন্তু প্রকৃতির এই নিয়মের বিপক্ষে এই ধাঁচের বিদ্রোহ এক ধরনের বোকামি অথবা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সবচেয়ে হতাশার বিষয় এটা যে প্রকৃতির নিয়মকানুনের অনেকগুলোই ইতোমধ্যে বিজ্ঞানের দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে এখনো অচেনাই রয়ে গেছে। এর মূলে রয়েছে জনতার রক্ষক হিসেবে পরিচিত সরকারগুলোর সতর্ক দৃষ্টি। তারা স্বইচ্ছায় মানুষকে এসব জ্ঞান থেকে সরিয়ে রেখেছে।

এখানে আরো একটি সমস্যা রয়েছে। প্রকৃতির নিয়মের অধিকাংশই মানবজাতির উন্নতির পর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত। এগুলো একদিকে যেমন প্রয়োজনীয়, আবার কখনো কখনো সেগুলো মারাত্মকও বটে। কারণ এই নিয়মগুলো বস্তুগত জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিকই কিন্তু বিজ্ঞান আজো সে নিয়মগুলোর অনেক অংশই নিজের করায়ত্তে নিতে পারে নি।

যখন এই নিয়মগুলো বিজ্ঞান পুরোপুরি জানতে পারবে, বাহ্যিক শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার মাধ্যমে মানুষকে জানাতে পারবে, সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে সমর্থ হবে তখনই মানুষের মুক্তির প্রশ্ন পুরোপুরি সমাধান হবে। প্রচন্ড মাত্রার একগুঁয়ে কোন লোকও সেদিন মানতে বাধ্য হবে পৃথিবীতে রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা বিধিবিধান কিংবা আইনের কোন প্রয়োজন নেই। যে সমস্ত লোকেরা সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে কিংবা সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করার মত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলে তারাও সেদিন কেবলমাত্র প্রকৃতির নিয়মের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে।

মোদ্দাকথা মানুষ পুরোপুরিভাবেই প্রকৃতির নিয়মগুলো মেনে চলে। কারণ সে এগুলোর মাঝেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারে এই নিয়মগুলো তার উপর বাইরে থেকে আরোপিত হয়নি। সেই আরোপিত বিষয় দৈব কিংবা মানবীয়, ব্যক্তিক কিংবা সামগ্রিক যাই হোক না কেন।

এবার একটি দক্ষ একাডেমির কথা ভাবুন। মনে করুন, একাডেমিটিতে যেখানে আছেন বিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোকিত প্রতিনিধিরা। ধরুন, এই একাডেমি সমাজের কর্তৃপক্ষ এবং আইনের দ্বারা অস্বীকৃত। একাডেমিটি বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আইনকে সুসংবদ্ধভাবে প্রয়োগ করে। তখন আসলে কী দেখবো? তাহলে আসল দেখা যাবে দুটি কারণে এই আইন এবং সমাজ সংগঠনটি বিকট মূর্তি ধারণ করবে। প্রথমত মানুষের বিজ্ঞান সব সময়ই মানুষের প্রয়োজন অনুসারে নির্ভূল হয় না; বিজ্ঞান কি আবিষ্কার করেছে এবং কি আবিষ্কার করে নি এর দোলাচলে আমরা বলতে পারি এই ব্যবস্থাটি এখনো শিশুকাল পার করছে। তাহলে আমরা দেখবো আমরা বিজ্ঞানের নিত্যনতুন ধারণার কঠিন ও কঠোর নিয়মের মাঝে নিজেকে আটকে ফেলছি। আমরা কি সেটি চাই? অবশ্যই তা নয়। আমরা সমাজ কর্তৃক মানুষের উপর আরোপিত কঠোর নিয়মগুলোকে উচ্চস্বরে ধিক্কার জানাই এবং অচিরেই আমরা সেই নিয়মগুলোকে স্থানচ্যুত করে সেগুলোর কণ্ঠরোধ করতে চাই। জীবন সব সময়ের জন্যই বিজ্ঞান থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস হিসেবেই যেন থাকে। এটাই আমরা চাই।

বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি এবং সুবিধা সম্বলিত পদ পদবিগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এটি মানুষের হৃদয় এবং মনকে খুন করে ফেলে। বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত কোন লোক, সে সুবিধা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক যেভাবেই তৈরি হোক না কেন এই ধরনের লোক মন এবং হৃদয় এই দুটি বস্তু হারিয়ে বসেন। আর এটা এমন একটা সামাজিক নিয়ম যাতে স্বাভাবিকভাবে কোন ব্যতিক্রম দেখা যায় না। শ্রেণী পেশা ব্যক্তি নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে এটা সমভাবে প্রযোজ্য।
বিজ্ঞানের বিষয়গুলো যখন সমাজের সরকারি চৌহদ্দিতে আটকে থাকে অচিরেই তার কাজের ক্ষেত্র বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলোতে ভাগ হয়ে যায়। এই অন্যান্য বিষয়গুলো সমাজের প্রতিষ্টিত শক্তির কারণে বিজ্ঞান অচিরেই সমস্ত সমাজের হাস্যকর কাজগুলোতে বেশি মনোনিবেশ করে বসে। পর্যায়ক্রমে এটি সরকারের হুকুম তামিল করার একটা হাতিয়ারে পরিণত হয়। তখন দেখা যায় বৈজ্ঞানিক একাডেমিগুলোর আর আইসভাগুলোর মধ্যে কার্যত কোনো পার্থক্য থাকে না।

তাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ব্যর্থ এসব কোনো কর্তৃপক্ষের সাথে আমি আলোচনায় বসবো না। এমনকি যদি বিশেষ কোন সমস্যা দেখা দেয় তবুও। তাদের সততা ও নিষ্টার জন্য যতটুকু সম্মান প্রাপ্য তা আমি অবশ্যই তাদের দিব। কিন্তু কোন ব্যক্তির মতামতের উপর আমার কোন পরম বিশ্বাস নেই। এই ধরনের বিশ্বাস আমার কার্যকারণ, মুক্তির প্রয়াস এমনকি আমার কাজের সফলতার ক্ষেত্রেও মারাত্মক হতে পারে। এটা আমাকে তৎক্ষণাৎ একজন বোকা দাসে পরিণত করবে। আমি হয়ে পড়বো অন্যের ইচ্ছা ও ভালো লাগার কেনা গোলাম।

আমি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত যেকোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কথা শুনবো এবং আমার কর্মতৎপরতা তাদের পরামর্শ মোতাবেক চালিয়ে যাব যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ইঙ্গিত এবং দিকনির্দেশনাগুলো আমার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হবে। এর কারণ তাদের নির্দেশনাগুলো আমার উপর মানুষ কিংবা দেবতা কারোরই আরোপ করা নয়। যদি আরোপ করা হত তাহলে আমি তাদের কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়া ছুঁড়ে ফেলে দিতাম। সেই শয়তানের সাথে এই মর্মে দেন দরবারে বসতাম যে, তার মত কর্তৃপক্ষগুলো কর্তাব্যক্তিদের বুদ্ধিমত্তা এবং দিকনির্দেশনা দেয়ার মত ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। ঐ দেন দরবারের পর আমার মুক্তির বাসনা এবং আত্মসম্মান হারানো সত্ত্বেও মিথ্যের চাদরে মোড়ানো সত্যের এই ঝুপকাষ্ঠা প্রজ্জলিত করার গুরুদায়িত্ব আমি নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিতাম।

আমার নিজের ভালোর জন্যই আমি বিশেষজ্ঞ লোকদের কর্তৃপক্ষের কাছে মাথা নত করবো। মানুষের জ্ঞান সমুদ্রের বিশালতা এবং জ্ঞান ভান্ডারের ক্রমিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সমস্ত কিছু আমি হয়তো জানি না। কিন্তু জ্ঞান অন্বেষণে আমি সর্বদা সচেষ্ট থাকি। জ্ঞান জগতের সমস্ত কিছু জানার মত সক্ষমতা সবার এক রকম নয় তা আমি জানি। আর ঠিক সে কারণেই সময়ের পরিক্রমায় বিজ্ঞান এবং শিল্পের সমস্ত ক্ষেত্রে শ্রমের ঐক্য এবং বিভাজন উভয়েই বিভাজন দেখা দিয়েছে। আমি যা জানি তা আমি অপরকে প্রদান করি এবং যা জানি না অপর মানুষজন থেকে তা গ্রহণ করি- এইতো মানব জীবন। প্রত্যেক মানুষ অন্যকে পরিচালনা করে এবং নিজের জন্য অন্যান্য মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। সুতরাং মানব সমাজে কোনো নির্ধারিত এবং স্থির কর্তৃপক্ষ নেই। বরঞ্চ সাময়িকভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় কিছু সময়ের জন্য অন্যের প্রতি নিবেদিত হয় এবং তাকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকার করে।

এই কারণে কোনো স্থির, নির্ধারিত এবং সার্বজনীন কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে আমি ইচ্ছুক নই। কারণ কোনো পরম মানুষের অস্তিত্ব মানব সমাজে নেই। একা কোন মানুষই মানব জগতের সমস্ত সম্পদের ভোগ দখল নিতে পারে না। সে কারণেই বিজ্ঞানের ব্যবহার ছাড়া মানব জীবন অচল। কেবলমাত্র বিজ্ঞানই হলো মানব সমাজের একক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদি বিজ্ঞান নামক এই পরম সত্ত্বা কেবল মাত্র কোনো ব্যক্তি বিশেষের অধিকারে থাকে এবং সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি যদি সেটার সুবিধা নিয়ে আমাদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায় তাহলে তখন তাকে অবশ্যই লাথি মেরে সমাজ থেকে বের করে দিতে হবে। কারণ তার একক কর্তৃত্ব সমস্ত মানুষের জন্য বয়ে আনবে জড়তা এবং দাসত্বের করুণ অভিশাপ। আমি মনে করি না সমাজ এ যাবৎকালে প্রতিভাধর মানুষের সাথে অসদাচরণ করে এসেছে। কিন্তু আমি এটাও মনে করি না তাদের এই প্রতিভার বদৌলতে তারা সমাজ থেকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাবার দাবি রাখে। তাদের এই সুবিধাগুলো না দেওয়ার পেছনে মূলত তিনটি কারণ উল্লেখ করা যায়: প্রথমত, তাহলে আমরা অনেক সময় একজন হাতুড়ে ডাক্তারকেই রোগের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করবো। দ্বিতীয়ত, ঐ হাতুড়ে ডাক্তারটিকে তোষামোদ করে সমাজ থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিতে থাকলে সেও নিজেকে কোন এক সময় বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারে। তৃতীয়ত, তার এই ভ্রমের কারণে সমাজে সে অন্যান্যদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে বসতে পারে।

সুতরাং সম্মিলিতভাবে আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মানসিক বিকাশ প্রক্রিয়ার পুণরুৎপাদন করা। এতে আমরা সবাই অবগত আছি যে, প্রকৃতির নিয়মগুলো সুবিবেচনা প্রসূত এবং সর্বতোভাবে মানুষের বস্তুজগত, বুদ্ধিবৃত্তিক জগত এবং নৈতিক জগতে প্রভাব বিস্তার করে। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ বাহ্যিক এবং সামাজিক এই দুই ভিন্ন জগতকে একত্রিত করে অনন্য এক জগত নির্মাণ করে। মানব সমাজের এই বৈধ কর্তৃপক্ষটি ছাড়া আমি অন্যান্য সমস্ত কর্তৃপক্ষকে মনে করি মিথ্যা, স্বৈরাচারী এবং মানব সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কেবল মাত্র এই কর্তৃপক্ষই বৈধ কারণ এর অধীন হওয়া যুক্তিযুক্ত এবং তা মানবমুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

অবশ্যই আমরা বিজ্ঞানকে পরম কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকার করি। কিন্তু এই সাথে আমরা তৎসংশ্লিষ্ট মহাপন্ডিতদের বিজ্ঞান বিষয়ক অমোঘ দাবি এবং সর্বব্যাপীতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। বিজ্ঞান নামক আমাদের চার্চে (আসলে আমি এই চার্চ শব্দটি অন্যভাবে ব্যবহার করার জন্য এখন মরিয়া হয়ে আছি; চার্চ এবং রাষ্ট্র শব্দ দুটি আমার হরিষে বিষাদের মত ঠেকে) প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের মতই একজন অদৃশ্য ঈশ্বর আছেন। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্টদের মত আমাদের কোন পোপ, কোন বিশপ, কোন পাদ্রী কিংবা অন্যান্য কাউন্সিলের কোন মহাপন্ডিতদের গুপ্ত আলোচনা শুনতে হয় না; তার একটাই কারণ আমাদের পন্ডিতেরা যুক্তি দিয়ে কথা বলে। তারা কোন অন্ধ বিশ্বাসে গা ভাসিয়ে দেয় না। আমাদের যীশু প্রোটেস্ট্যান্ট এবং খ্রিষ্টানদের যীশুর থেকে এই অর্থে ভিন্ন যে- খ্রিষ্টানদের যীশু ব্যক্তিমাত্র, আমাদের যীশু সামগ্রিক; খ্রিষ্টানদের যীশু ইতোমধ্যেই তার পূর্ববর্তী সমস্ত আত্মগ্লানি ভুলে নিজেকে একজন যথার্থ মানব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞান নামক আমাদের এই যীশুর পরিপূর্ণ এবং যথার্থ হবার কাল অতীতে নয়, ভবিষ্যতের দিকে। এই ভবিষ্যতের কথা পূর্ববর্তী যীশুভক্ত অন্ধের দল চিন্তাতেও আনতে চান না। তাই, আমরা পরম সময়ের নিয়ন্তা বিজ্ঞানকেই আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে পরম কর্তৃপক্ষ হিসেবে মনে করি।

আমার লেখায় আমি বিজ্ঞানকে যে “পরম সত্ত্বা” হিসেবে উল্লেখ করেছি, তার একমাত্র কারণ এটি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়। এই বিজ্ঞান প্রাকৃতিক নিয়মের মিথস্ক্রিয়ায় গঠিত বিশ্বের অসীম জ্ঞান ভান্ডারের অবিরাম উন্নতির তত্ত্বের বিকাশ করতে থাকে। এটা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান যে মানুষের সমস্ত চিন্তার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান নামক যে সুমহান বস্তুর সৃষ্টি হয় তা কখনোই পরিপূর্ণ রূপে সমগ্র সত্ত্বা নিয়ে বিকাশ লাভ করতে পারে না। আমাদের যীশু এজন্য অপূর্ণই থেকে যায় এবং যার কারণে আমাদের কাছে তার লাইসেন্সধারী প্রতিনিধিদের গর্ব করার মত কিছুই থাকে না। যেখানে প্রকৃত ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে যারা তার পুত্রের নাম করে আমাদের উপরে তাদের দাম্ভিক এবং গোঁড়ামিতে ভরপুর কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ চাপিয়ে দিতে চায় সেখানে আমরা আমাদের সত্যিকারের ঈশ্বরের কাছেই মাথা নত করি। আমাদের ঈশ্বর বস্তুজগতের ঈশ্বর। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার নিত্য চলাচল। অন্যদিকে ঈশ্বরের পুত্র নামে কল্পিত ঈশ্বরটি সেই বিশাল ঈশ্বরের বিশাল বস্তুর কিয়দাংশ মাত্র। প্রকৃত ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা মানুষেরা এই জগতেই বাস করি, কাজ করি, সংগ্রাম করি, ভালবাসি, এক অপরের সথে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই, আনন্দ উপভোগ করি, এমনকি দুঃখ দুর্দশাও ভোগ করি।

বিজ্ঞানের পরম সার্বজনীন এবং অনিবার্য কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলেও আমরা সদিচ্ছায় বিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্য, তুলনামূলকভাবে প্রাসঙ্গিক, সমসাময়িক এবং আপাত দৃষ্টিতে স্থির শাখাগুলোর কাছে মাথা নত করি। কারণ সময়ের পরিক্রমায় ঘুরে ফিরে বারবার আমাদের এই আলোচনাগুলোই করতে হয় এবং মানুষের দেয়া চমৎকার এ তথ্যগুলো আমাদের বিমোহিত করে। বিশেষজ্ঞ এবং আমাদের মধ্যে জ্ঞান আদান প্রদানের এই মিথস্ক্রিয়ার ফলে একটা সময় আমরা দক্ষতায় তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠি কিংবা কখনো কখনো তাদেরকেও ছাড়িয়ে যাই। সাধারণভাবে, মানুষের বুদ্ধির দ্বারা অলঙ্কৃত সুমহান জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, সর্বোপরি হৃদয়ের বিকাশ আমাদের আশাদীপ্ত করে। কেবলমাত্র প্রকৃতির এবং বৈধ কর্তৃপক্ষগুলোর অধীনতা স্বীকার করে নামী বেনামী, পার্থিব কিংবা অপার্থিব সমস্ত কর্তৃপক্ষকেই তারা তাদের মহান চিন্তার মধ্য দিয়ে নস্যাৎ করে দিতে পারে। একেবারে খাঁটি কিংবা বিশুদ্ধ এরকম সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে আমরা কার্যকারণ বিচার করে প্রকৃতির কর্তৃত্ব স্বীকার করি। কারণ ধর্মবাদীরা যখনই বিশুদ্ধ কোনো জিনিস আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে, মেকি ভ্রমের মায়াজালে তৎক্ষণাৎ তা শোষণের চাবি হয়ে উঠেছে।
এক কথায়, আমরা আমাদের কর্মকান্ডে সমস্ত কালাকানুন, সমস্ত কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষ সুবিধাধারী, লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা সরকারি কর্মচারিদের সমস্ত নগ্ন হস্তক্ষেপ অস্বীকার করি। এমনকি যদি এ সমস্ত ব্যক্তিরা সার্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে আসেন তবেও আমরা তাদের মানি না। কারণ আমরা মনে করি কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রিক এই ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ট শোষিতদের মাটি চাপা দিয়ে সংখ্যালঘিষ্ট শোষকদের শোষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
ঠিক এই কারণেই আমরা নিজেদের নৈরাজ্যবাদী বলে থাকি।

আধুনিক ভাববাদীরা অবশ্য কর্তৃপক্ষের ধারণাটিকে একটু ভিন্নভাবে বুঝে। বিদ্যমান ধর্মগুলোর সাধারণ সব কুসংস্কার থেকে নিজেদের দূরে রাখার সাথে সাথে তারা পরম, স্বর্গীয় কোন কর্তৃপক্ষের ধারণাও খারিজ করে দেয়। দৈব প্রক্রিয়ায় হঠাৎ করে প্রকাশিত কিংবা বিজ্ঞানের দ্বারা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত; দুটোর কোনটিকেই তারা কর্তৃপক্ষ হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের স্বীকৃত কর্তৃপক্ষের ধারণা আপাত দৃষ্টিতে দার্শনিক। মোটা দাগে বলতে গেলে ভাবের দিক দিয়ে তাদের মেনে চলা এই কর্তৃপক্ষ তাদের বিমূর্ত হৃদয়ের কাব্যিক অনুভূতির উপর প্রতিষ্টিত। সে কারণেই তাদের মেনে চলা ধর্মও পূর্বেকার সমস্ত ধর্মগুলোর মত মানুষের মানবীয় সত্ত্বাকে স্বর্গীয় বাতাবরণে আভূষিত করতে চায়।
এর ঠিক বিপরীত কাজটিই করছি আমরা। মানুষের মুক্তি, সম্মান এবং উন্নতির পক্ষে নিজেদের রেখে আমরা বিশ্বাস করি স্বর্গ যে সমস্ত ধন সম্পদ পৃথিবী থেকে চুরি করে সরিয়ে নিয়ে গেছে সেগুলোকে পুণরুদ্ধার করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর বিপরীতে ভাববাদীরা সব সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর সম্পদ স্বর্গে অপহরণ করে নিয়ে যাবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখন সময় এসেছে মানুষের মহৎ, সুন্দর এবং উন্নত গুণাগুণের দ্বারা এই স্বর্গীয় ডাকাতদের মুখোশ খুলে দেয়ার। এখন সেই সময় যখন মুক্ত চিন্তকেরা তাদের স্পর্ধা এবং বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে স্বর্গ লুট করে সেখানকার সম্পদগুলো আবারো পৃথিবীতে নিয়ে আসবে।
ভাববাদীরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে, মানুষের মধ্য থেকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হবার জন্য মানুষের সমস্ত চিন্তা এবং কর্মগুলোর স্বর্গীয় অনুমোদন লাভ অবশ্য প্রয়োজনীয়। এই অনুমোদন মানুষের পক্ষে কিভাবে পাওয়া সম্ভব? পূর্বের ধর্মগুলোর মত অবশ্যই দৈব কোন স্বপ্নে কিংবা অহীর মাধ্যমে এই স্বর্গীয় অনুমোদন মিলবে না। বর্তমানে এটা তখনই মিলবে যখন মানুষের সমস্ত চিন্তা ও কাজে পবিত্রতা বিরাজ করবে। সেই পবিত্রতার মূল কথা হলো যা কিছু মহান, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু উন্নত সমস্ত কিছুই হলো স্বর্গীয়। এভাবেই তারা পবিত্রতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।

নব্য প্রতিষ্টিত এইসব ধর্মমতে মানুষ যদি দৈব চিন্তা করে তার কর্ম করে যায় তাহলে সে ঈশ্বরকে পেয়ে যায়। আপনা আপনিই সে বনে যায় তার ধর্মের একজন প্রতিষ্টিত পুরোহিত কিংবা পাদ্রী। এখন প্রশ্ন হলো সে যে পুরোহিত কিংবা পাদ্রী হলো তার প্রমাণ কী? আদৌতে কোনো প্রমাণ নেই। যে সুমহান চিন্তাগুলো সে প্রকাশ করে কিংবা যে কর্মগুলো সে সম্পাদন করে সেটার জন্য তার কারো কাছে জবাবদিহি করার কোনো প্রয়োজন নেই। সে মনে করতে থাকে তার এই কাজগুলো এতটাই পুত পবিত্র যে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কেউ এর মর্মার্থ বুঝতে পারবে না। সুতরাং প্রমাণ দেয়ার কি প্রয়োজন!

তাই অল্প কথায় তাদের সমগ্র দর্শনটা হলো খানিকটা এরকম; একটা দর্শন যেখানে বাস্তব চিন্তা অপেক্ষা অনুভূতি বেশি প্রাধান্য পায়। মোদ্দাকথায় তাদের এই দর্শন আধিবিদ্যিক ভাব ভক্তির উপর প্রতিষ্টিত। এটাকে আপাত দৃষ্টিতে ভাল মনে হলেও এটি মোটেই তা নয়। সুস্পষ্টাবে এটা এমন এক সংকীর্ণ এবং নিষ্টুর মতবাদ যার অধরা-অস্পষ্ট কাব্যিক রূপও পূর্বেকার সমস্ত ধর্মগুলোর মতই বিপদজনক। এটি পূর্বের ধর্মগুলোর মতই মানুষের মুক্তি এবং সম্মানের আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে।

স্বর্গীয় সমস্ত কিছুকে মহৎ, অভিজাত এবং সুন্দর মানার অর্থ হচ্ছে মানুষ এগুলো তৈরি করতে অসমর্থ। তার মানে দাঁড়ায়, মানুষ তখন বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছায় এই অন্যায়ের কাছে, অস্পষ্টতার কাছে, কুৎসিত এই জিনিসটার কাছে নিজেকে সঁপে দিবে। এটাই হলো সমস্ত ধর্মের মূল কথা। এটি স্বর্গের সমস্ত বিজয়োলাøাসের কাছে মানুষের ভূমিকাকে পদদলিত করে। আর যে মুহূর্ত থেকে মানুষ তার স্বাভাবিকতা হারায়, যখন থেকে স্বর্গীয় ধারণাগুলোকে সত্য বলে মেনে নেয়, তখন প্রশ্নাতীতভাবেই পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর সমস্ত ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরম্পরা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়। স্বর্গীয় দালালেরা মানব জাতিকে ঈশ্বরের নাম নিয়ে আলোকিত করে স্বর্গের ভিসা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের উপর খবরদারি করতে শুরু করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমস্ত মানুষই কি সমানভাবে ঈশ্বরের কৃপাধন্য হয়? যদি হয় তাহলে এটা তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পৃথিবীতে স্বর্গীয় দালালদের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু সমাজে এমন কিছু কারণ বিরাজমান যার জন্য এই দালালদের সমাজ থেকে অপসারণ করার চিন্তাও অনেক সময় মাথায় আনা যায় না। সমাজের বিদ্যমান এই কারণগুলো ধর্মের সমস্ত হাস্যকর ও ভ্রান্তিমূলক তত্ত্বগুলোকে অনুমোদন দিতে আমাদের বাধ্য করে। এর কারণে তাদের সমস্ত মূর্খতা, তাদের সৃষ্ট সমস্ত ভয়ভীতি এবং কাপুরোষিত আচরণ সমাজে প্রতিষ্টা পেয়ে যায়। ইতালীয় নাগরিক জিওসিপ্পি মাজ্জিনি এরকমই একজন ছিলেন। ঈশ্বরের কৃপাধন্য হবার পরপরই গণমানুষের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে তিনি সেই সময়ে ইতালিতে সরকার গঠন করেছিলেন। তাহলে সবাই সমানভাবে কৃপাধন্য হলো কিভাবে? কৃপার বড় অংশ তো মাজ্জিনির দিকেই চলে গেলো। ঈশ্বরের কৃপা আসলে এভাবেই বন্টিত হয়।

এখানে আমরা আবারো চার্চ এবং রাষ্ট্রের বেড়াজালে আটকা পড়ে যাই। এই সংস্থাগুলো অন্যান্য সকল রাজনৈতিক সংস্থার মতো আমাদের ঋণগ্রস্থ করে তোলে। যদিও এই আধুনিক যুগে এটি মানুষদের কর্তৃত্ব খানিকটা অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু এটার প্রস্তাবনা তৃতীয় নেপোলিয়নের সা¤্রাজ্যবাদী ফরমানগুলোর মতই। সুতরাং নিজের ভোল পাল্টে নবগঠিত এই চার্চ যদি কিছুটা হলেও মানুষের ইচ্ছাতে চলে তবে একে চার্চ না বলে জনমানুষের বিদ্যালয় বলাই এই মুহূর্তে শ্রেয় হবে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? নতুন এই বিদ্যালয়ের ব্রেঞ্চগুলোতে তো কেবলমাত্র শিশুরা বসবে না। এখানে স্থান হবে তথাকথিত ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত চিরস্থায়ী ছোটলোকদেরও। এদের দৌরাত্ম থামাবে কে?
যে মানুষগুলো স্বর্গের পরীক্ষায় কখনোই পাশ করতে পারে না, যে মানুষগুলো স্বর্গীয় দূত কর্তৃক পঠিত জ্ঞান আত্মস্থ করতে পারে না, যারা স্বর্গীয় নিয়মশৃঙ্খলার প্রয়োগ ঘটাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় অর্থাৎ যারা প্রকৃত জনগণ তাদের কী হবে? তাদের ব্যাপারে কোনো সমাধান আছে এই বিদ্যালয়ে?

রাষ্ট্র তখন আর নিজেকে রাজতন্ত্র বলে দাবী করতে পারে না; তখন বাধ্য হয় নিজেকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তাতেও কি রাষ্ট্র নিজের চরিত্র পাল্টায়? না। তখন রাষ্ট্র কিছু সংখ্যক লোককে ব্যাপক জনমানুষের অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করে। মহৎ গুণ কিংবা প্রতিভার অধিকারী অল্প সংখ্যক এই মানুষগুলো মানব ইতিহাসের ভাস্কর, উদ্যমী এবং সম্মিলিভভাবে পরাক্রমশালী ব্যাপক জনতার উপর ছড়ি ঘুরাতে শুরু করে। তারা নিজেদেরকে প্রজাতন্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ যেরকম ভেড়ার পাল হিসেবে ছিল সেরকমই থেকে যায়। আর প্রজাতন্ত্রীরা হয় রাখাল। লোমকাটা এই রাখালদের ব্যাপারে তাই সবসময় সচেতন থাকতে হবে।
বর্তমান সিস্টেমে মানুষ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তারা এই রাখালদের শিষ্য হতে বাধ্য। নিজেদের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটা মানুষ তাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক মনে করতে থাকে। তারা প্রতিনিয়তই অন্যের চিন্তার, ইচ্ছার এবং স্বার্থের সেবা করে যায়। এই অবস্থার মধ্যে যাকে আমরা মুক্তি বলি, সেই প্রকৃত মুক্তির চিন্তা রসাতলে চলে যেতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় পুরাতন শোষণ এবং দাসত্ব নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসে। এই দাসত্ব যেখানে থাকে সেখানে নির্দয়তা এবং মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সুবিধাবাদী শ্রেণী এবং সাধারণ মানুষ উভয়ের মধ্যেই প্রকৃত সামাজিক বস্তুবাদের চিন্তা তখন নতুনভাবে দেখা দেয়।

মানবজাতির সুবিধা-অসুবিধাগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাববাদীরা শেষ পর্যন্ত পাশবিক বস্তুবাদেরই জয়জয়কার ঘোষণা করে। এর কারণটাও খুব সরল। তাদের মধ্যে তখন দৈব সুখের চিন্তা উবে গিয়ে নিজেদের দেশেই স্বর্গভোগ করা চিন্তা আসে। যার কারণে পাশবিক এই ভাববাদী গোষ্ঠী পৃথিবীতেই নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করার কথা ভাবতে থাকে। আসলে ভাববাদের তত্ত্বগত বুনিয়াদ প্রকৃতপক্ষে পাশবিক বস্তুবাদ ছাড়া কিছুই নয়। তবে হ্যাঁ, যারা প্রকৃতপক্ষে ভাবের দুনিয়ার সন্ধান করে তারা এই হিসাবের বাইরে থাকবে। সেই প্রকৃত ভাবের দুনিয়ার লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পায় ভাবের দুনিয়ায় পৌঁছানোর জন্য তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা আন্দোলন ছাড়া কিছুই নয়। তারা ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ভাববাদীরা মানুষের জীবনে তাদের প্রচারিত নিয়ম কানুনগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে চায়। পুরো মানব সমাজটাকে তারা তাদের ভাববাদী মতবাদ দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে। যা প্রকারান্তে পাশবিক বস্তুবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাদের প্রচারিত সাধারণ নিয়মগুলো প্রথমে মানুষের কাছে অদ্ভুত ঠেকলেও তারা ধীরে ধীরে ইতিহাসের প্রমাণাদি হাজির করে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এই তথ্য প্রমাণাদি হাজির করার ব্যাপারে তাদের কখনো কার্পণ্য করতে দেখা যায় না।

প্রাচীন কালের দুটো পুরাতন সভ্যতা- গ্রীক এবং রোমান সভ্যতার মাঝে তুলনা করুন। এদের মধ্যে কোনটি বেশি বস্তুবাদী? ইতিহাসে কোনটি বেশি স্বাভাবিক? মানবজাতির জন্য এদের মধ্যে কোনটি আদর্শ সভ্যতা ছিল? সন্দেহতীতভাবে সেটি হলো গ্রীক সভ্যতা। বিপরীত দিকে চরিত্রগতভাবে কোনটি বেশি ভাববাদী ছিল? কোনটি দাসদের বস্তুগত স্বাধীনতাকে সভ্য নাগরিকদের ভাববাদী স্বাধীনতার কাছে বলি দিয়ে আইন প্রণয়ন করেছিল? কোনটির মাধ্যমে মানব সমাজের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছিল? ইতিহাসে কোনটির চেয়ে পাশবিক আর কোন সভ্যতা হয় না? নিঃসন্দেহে তা হলো রোমান সভ্যতা। এটা সত্য যে রোমসহ অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মত গ্রীক সভ্যতাও তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদী ছিল। দাসত্বের উপর ভিত্তি করেই এগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুটো সমসাময়িক সভ্যতা অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাগুলোর চেয়ে আধুনিক ছিল। অন্যান্য পুরাতন সভ্যতাগুলো কখনোই মানবতাকে তাদের ইতিহাসে জায়গা দেয় নি। সেখানে গ্রীক সভ্যতা মানুষের জীবনকে মহান এবং আদর্শ হিসেবে দেখেছিলো। এটা মানুষের পশুসুলভ অবস্থার কোরবানি করে তাদের মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত মানুষ হিসেবে চিন্তা করার খোরাক জুগিয়েছিল। মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে বিজ্ঞান, শিল্প, কবিতা এক অমর দর্শন এবং মানুষ হিসেবে সম্মান প্রাপ্তির পথ দেখিয়েছিল এই সভ্যতা। রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির মধ্য দিয়ে এই সভ্যতা মুক্ত চিন্তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। মধ্যযুগের শেষভাগে রেঁনেসার সময়ে কিছু গ্রীক অভিবাসী তাদের অমর গ্রন্থগুলোর কিছু সংখ্যক ইতালিতে নিয়ে এসেছিলো। যেগুলো ইতালিয়ানদের জীবনকে পুণরুজ্জীবিত করে মুক্তি, চিন্তা এবং মানবতার ধারণা নিয়ে এসে ক্যাথলিকিজমের অন্ধকূপ থেকে তাদের বের করেছিল। সুতরাং, মানুষের মুক্তি এসেছিল গ্রিক সভ্যতার নাম নিয়ে। তাহলে রোমান সভ্যতার নাম নিয়ে কী হয়েছিল? রোমান সভ্যতার নাম নিয়ে বিজয় হয়েছিল সমস্ত পাশবিক সত্ত্বার। এই সভ্যতাজুড়ে ছিল সমস্ত জাতি এবং মানুষদের নিদারুণ দাসত্ব বরণ এবং মানবতার চরম অধঃপতন।

এমন কি আজো, সিজার তথা রোমান সা¤্রাজ্যের বিজয়োল্লাস যা মানুষ খুন করে, যা সমস্ত পৃথিবীকে পাশবিকতার হাসি হেসে গুঁড়োগুঁড়ো করে দেয়, যা ইউরোপের সমস্ত দেশে মুক্তি এবং মানবতাকে গলা টিপে ধরে রাখে।
এখন ইতালিয়ান এবং জার্মান এই দুটো আধুনিক সভ্যতার মাঝে তুলনা করুন। নিঃসন্দেহে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমটির সাধারণ চরিত্র হলো বস্তুবাদ। বিপরীত দিকে দ্বিতীয়টি ভাববাদকে আরো বিমূর্ত, সবচেয়ে বিমূর্ত এবং সর্বাধিক অতিন্দ্রিয়বাদী মতবাদ হিসেবে প্রচার করে। চলুন আমরা দেখি বাস্তবে এই দুটি সভ্যতা মানবজাতির জন্য কি ফল বয়ে নিয়ে এসেছিল।

মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে ইতালি ইতোমধ্যেই প্রচুর কার্য সম্পাদন করেছে। ইতালিই সর্বপ্রথম মানবজাতির মুক্তির বাসনাকে পুণরুজ্জীবিত করে তার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিল এবং তারাই শিল্প, ব্যবসা, কবিতা, চিত্রকলা, ইতিবাচক বিজ্ঞান এবং মুক্তচিন্তার মধ্য দিয়ে মানবতাকে দেবত্ব থেকে অভিজাত করে তুলেছিল। বিগত তিন শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানকে ভেঙেচুড়ে দিয়েছিল যে সা¤্রাজ্যবাদ এবং পোপের স্বৈরতন্ত্র, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় যে সমস্ত বুর্জোয়ারা বিজ্ঞানকে মাটির নীচে কবর দিয়েছিল, সেই বাজে অবস্থা থেকে ইতালিই মানবজীবনে বিজ্ঞানের আবেদনকে পুণরুদ্দার করেছিল। ইতালিতে বাজে অবস্থা সৃষ্টির পরেও আমরা খানিকটা আশান্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে সেখানে একজন লোক মানবিকভাবে জীবনধারণ করতে পারতো এবং সেখানে সে এমন কিছু সঙ্গী পেত যাদের জন্মই যেন মুক্তির লক্ষ্যে হয়েছিল বলে মনে হত। ইতালি বুর্জোয়াদের দ্বারা অধিকৃত হবার পরেও মাজ্জিনি এবং গ্যারিবল্ডির মতো লোকেদের নিয়ে গর্ব করতে পারত। অন্যদিকে জার্মানির অবস্থা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সেখানে একজন মানুষকে তীব্র রাজনৈতিক এবং সামাজিক দাসত্বের মধ্যে জীবন ধারণ করতে হতো। দার্শনিকভাবে জার্মানির লোকেরা নিজেদের ইচ্ছা এবং মর্জিকে শাসকদের কাছে বলি দিতে বাধ্য হতো। আসলে জার্মানির নায়কেরা ছিলেন মাজ্জিনি কিংবা গ্যারিবল্ডির ঠিক বিপরীত। তারা হলেন প্রোটেস্ট্যান্টদের ঈশ্বরের মনোনীত ভয়ংকর এবং নির্দয় প্রথম উইলিয়ামের মতো ব্যক্তিবর্গ, বিসমার্ক এবং মল্টকের মত ভদ্র মহোদয়গণ, জেনারেল ম্যান্টুফেল এবং ওয়ের্ডার মতো সামরিক কর্মকর্তা। জার্মানির অস্তিত্বের শুরু থেকেই দেশটি বেশ সুশৃঙ্খলভাবে আক্রমণাত্মক ছিলো। বিজয়ী হবার নেশায় দিগ¦ীদিক ছুটে বেড়াত তারা। এমনকি তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমানায় পৌঁছে দিতেও তাদের বিন্দুমাত্র বাঁধে নি। একক ক্ষমতাশালী হিসেবে আবির্ভূত হবার পর থেকে জার্মানি সমস্ত ইউরোপের মুক্তির পথে কাঁটা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিল।

ভাববাদের তত্ত্বগত দিকটি কিভাবে অহর্নিশি অনিবার্যভাবে বাস্তবে বস্তুবাদে পরিণত হয় সেটা দেখানোর জন্য একজনের বেশী কিছু করার দরকার নেই। কেবল মাত্র খ্রিষ্টানদের চার্চের শ্লোকগুলো মুখস্ত রাখতে পারলেই তা হয়ে যাবার কথা। যদি সেটা এপোস্টলিক কিংবা রোমান চার্চের শ্লোক হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। খ্রিস্টের মতবাদগুলো যত বেশি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তা তত বেশি মহিমান্বিত হবে। সেটাই যদি হয় তবে কি ঐ চার্চ খ্রিষ্টের মতবাদের বাহিরে চলে যায় না? তাহলে তো ৮ম শতাব্দীর চার্চ কেন্দ্রিক খ্রিষ্ট ধর্মের যে চর্চা শুরু হয়েছিল তা থেকে বর্তমানকালের বস্তুবাদী চার্চগুলো অনেক বেশি মাত্রায় ব্যতিক্রমী। সেটা কীজন্য? সেটা কী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের অধিষ্টিত করার লক্ষ্যে নয়? তাহলে পুরো ইউরোপের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে চার্চের পূর্বের এবং বর্তমানের অবস্থানের ব্যাখ্যা কি দাঁড়াল? সেটা হল অস্থায়ী এবং এক ঈশ্বরের মূর্তি সামনে রেখে প্রথমে রাজস্ব আদায়, তারপর অস্থায়ী ক্ষমতা লাভ এবং সবশেষে রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদায় করা। তবে আমাদের এটা স্বীকার করে নিতেই হবে বস্তুবাদী চার্চের কারণেই আমরা প্রথম এই অদম্য সত্যের কথা জানতে পারি যে, সম্পদ, ক্ষমতা, জনগণের উপর অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন ভাববাদের দুনিয়ায় একই মুদ্রার এপিট ওপিট। এগুলোর প্রত্যেকটিই স্বর্গীয় সুখ প্রাপ্তির লক্ষ্যে এপিস্টলিক চার্চ কর্তৃক দেখানো শহীদী মৃত্যু অপেক্ষা অধিক সুখদায়ক।

আমি ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং সুইজারল্যান্ডের স্বাধীন চার্চগুলোর কথা বলবো। জার্মানির পরাধীন চার্চগুলো আমার বক্তব্যের মধ্যে পড়বে না। জার্মানির চার্চগুলো স্বউদ্যোগে কিছুই করে না। তাদের সাময়িক সার্বভৌমত্বের আত্মিক গুরুরা যা বলে তারা সেটাই করে। আর এটা কারো অজানা নয় যে, প্রধানত ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা দেশদুটিতে প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রচারিত প্রোপাগান্ডা বস্তুবাদী এবং বাণিজ্যিক স্বার্থধারীদের প্রচারিত প্রোপাগান্ডার মতই। তারা বিভিন্ন দেশে ঈশ্বরের বাণী প্রচারের লক্ষ্যে কোম্পানি প্রতিষ্টা করে এবং সেই দেশ লুট করে তারা একটি বিশেষ শ্রেণীর ধন সম্পদ বৃদ্ধি করে। যারা এই কাজগুলোতে অংশ নেয় সেই সমস্ত ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের দেশে একই সাথে ধার্মিক কিন্তু অর্থের প্রতি লোভও তাদের মধ্যে প্রচন্ড মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এক কথায় বলতে গেলে ইতিহাস পাঠ করে এটা প্রমাণ করা তেমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয় যে, সমস্ত চার্চ, সেটা খ্রিষ্টান চার্চ হোক কিংবা অখ্রিষ্টান চার্চ হোক সেগুলোর আধ্যাত্মিক প্রোপাগান্ডা ছাড়াও তাদের সাফল্যকে বৃদ্ধি করে পর্বতসম করার জন্য দৈব আশীর্বাদ কিংবা অন্যান্য উপায়ের সহযোগিতায় তারা জনগণের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চাপিয়ে দেয়। একই ভাবে সব রাষ্ট্রগুলোর বেলাতেও আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রগুলো তাদের রাজনৈতিক এবং বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগিয়ে, সমাজের অধিপতি ও সুবিধাবাদী শ্রেণীগুলোর সহযোগিতায় চার্চের মতই ব্যাপক সংখ্যক লোকের উপর শোষণ নিপীড়নের খড়গ চালিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষের পেটকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে। যার দরুণ জনতার মাঝে ধর্মান্ধতা এবং ভাববাদের বদলে জায়গা করে নিয়েছে কুৎসিত ভোগ সর্বস্ব বস্তুবাদ।

আজকের দিনে নতুনভাবে আমরা এর প্রমাণ পাই। তথাকথিত মহান আত্মা এবং যে মানুষগুলো এখনো পৃথিবীতে আছেন যাদেরকে আমি পূর্বে পথভ্রষ্ট বেদুইন বলেছিলাম, বর্তমানে তারা ছাড়া ভাববাদের আসলেই কি আর কোনো রক্ষক আছে? তারাই তো বর্তমানে স্বাধীন সার্বভৌম দেশগুলো চালাচ্ছে। ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়ন এবং তার স্ত্রী মাদাম ইউগেনি; তাদের সমস্ত প্রাক্তন মন্ত্রী, রাজসভাসদ, রোহের এবং রাজাইন থেকে শুরু করে ফ্লিওরি এবং পিয়েট্রি পর্যন্ত তাদের সমস্ত প্রাক্তন সেনাপতি এই সমস্ত পুরুষ এবং মহিলারাই সার্বভৌম ফ্রান্সকে মহিমান্বিত করে তাকে রক্ষা করেছিল। তাদের সাংবাদিক সহ অন্যান্য মহাপন্ডিতেরা ক্যাসাগনাকাস, গিরারদিন, ডুভারনইস, ডুইলটস, রেভেরারিস, ডুমাস; উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফ্রান্সের সমস্ত বুর্জোয়া মতবাদ ধারণাকারী উদারপন্থী এবং মতবাদবিহীন উদারপন্থী- যাদের মধ্যে গুইজট, থিয়ারস, জুলেস ফারভেস, পেলিটান্স এবং জুলেম সিমন্স; এদের সবাই ছিল মোটাদাগে ফ্রান্সের বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গের রক্ষক। প্রুশিয়া এবং জার্মানিতে প্রথম উইলিয়াম, তার সমস্ত জেনারেল, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে এক সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন যার সদস্যদের সকলেই পরিপূর্ণরূপে ধর্মে বিশ্বাসী। তারা যে উপায়ে ফ্রান্স দখল করেছিলেন তাও সকলের জানা। রাশিয়াতে সিজার পোল্যান্ডের ধার্মিক কসাইদের তার বিচারকমন্ডলিতে মৌরাবিফ এবং বার্গের মত স্থান দিয়েছেন । প্রতিটি জায়গায় ধর্ম কিংবা দার্শনিক ভাববাদ হাতে হাত ধরে রক্তক্ষয়ী এবং পাশবিক বস্তুগত শোষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। অন্যদিকে এর বিপরীত তত্ত্বগত বস্তুবাদের দর্শন, অর্থনৈতিক সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের লাল পতাকা শোষিত এবং নিপীড়িত মানুষের দ্বারা “আদর্শ” হিসেবে প্রতিষ্টিত হয়েছে। যা মানব মুক্তি এবং অধিকারের মহৎ চিন্তাকে হৃদয়াঙ্গম করে সমস্ত মানুষের জন্য উর্বর জমি প্রদানের অঙ্গীকার নিয়ে তার কাজ শুরু করেছে।

আসলে সত্যিকারের মসীহ কারা? যারা বিমূর্ততার আদর্শ বর্জন করে আদর্শকে জীবন ঘনিষ্ট করেছে, যারা স্বর্গকে বাদ দিয়ে পৃথিবীকে আপন করে নিয়েছে, তারা নয় কী? এটা প্রমাণিত যে, স্বর্গীয় ভাববাদ প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত হলো যুক্তিকে বিসর্জন দেয়া, কার্যকারণকে অপসারণ করা এবং বিজ্ঞানকে বলি দেয়া। আমরা পরবর্তীতে আরো দেখতে পাই যারাই ভাববাদী মতবাদগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে তাদের ভালো লাগুক কিংবা না লাগুক তাদেরকে জনগণের শোষকদের দলভুক্ত হতে হয়েছে। এই কারণটিই ভাববাদ সমর্থনকারীদের সুমহান মন এবং হৃদয় বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের সমসাময়িক ভাববাদীদের, যাদের কিনা সুমহান মন এবং হৃদয়ের কোন কমতি নেই এবং যাদের সদিচ্ছা কিংবা মানব জাতির কল্যাণে নিজেকে সঁপে দেওয়া নিয়েও কেউ কোন দিন প্রশ্ন তুলতে পারবে না, তাদের সাথে এটি কিভাবে ঘটে?

তারা নিশ্চয়ই একটি শক্তিশালী উদ্দেশ্য দ্বারা প্ররোচিত। যেহেতু যুক্তি এবং বিজ্ঞান অনেক আগেই ভাববাদী মতবাদ সম্বন্ধে তাদের রায় ঘোষণা করেছে, সেহেতু এই শক্তিশালী উদ্দেশ্য যুক্তি কিংবা বিজ্ঞান হতে পারে না। যেহেতু অনেক আগেই তারা ব্যক্তিবাদের উর্ধ্বে চলে গিয়েছে, সেহেতু এটা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যেও হতে পারে না। তাহলে নিশ্চয়ই এটা নৈতিক কোন উদ্দেশ্য হবে। সেটা কোনটা? এক্ষেত্রে একটিই উদ্দেশ্য হতে পারে। আর সেটা হলো, ভাববাদী তত্ত্ব কিংবা বিশ্বাসের সম্মান এবং মোহনীয়তা বৃদ্ধি।

এবার বস্তুবাদী ও ভাববাদী বিদ্যালয়ের দিকে একটু দৃষ্টি দেই। আমি আগেই বলেছি প্রতিটি সৃষ্ট ঘটনার যেমন একটা জন্মসূত্র থাকে, তেমনি তার ধ্বংসও থাকে। বস্তুবাদী বিদ্যালয়ের শিক্ষা মোতাবেক একেকটি ঘটনাকে বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিচার করা উচিত। বস্তুজগতের সমগ্রতা দিয়ে শুরু করলে কিংবা বিমূর্তরূপে যেভাবে “বস্তু” নামক ধারণার সৃষ্টি হয়, যৌক্তিকভাবে তার সত্যিকারের রূপ পাওয়া সম্ভব কেবলমাত্র বস্তুর পরিপূর্ণ মূর্তায়নের মাধ্যমে। যার মানে দাঁড়ায় সমাজের সম্পূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে বস্তুকে মানবিকীকরণ করার মধ্য দিয়েই বস্তু সৃষ্টির ধারণা সম্পূর্ণ হয়। অন্যদিকে ভাববাদীদের বিদ্যালয় ঠিক এর বিপরীত। চার্চ ও রাষ্ট্র এই দুই সংস্থা কর্তৃক পাশবিক স্বৈরাচার এবং অন্যায় ও শোষণের মাধ্যমেই সমাজে ভাবের আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়। বস্তুবাদীদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা মোতাবেক মানুষের ঐতিহাসিক বিকাশ হল একটা পর্যায়ক্রমিক উত্তরণ। ভাববাদী সিস্টেমে তা পতন ছাড়া আর কিছুই নয়।

এমতাবস্থায় আমি যা বুঝতে পারছি তা হলো বস্তুবাদ পশুত্ব থেকে পর্যায়ক্রমে মনুষ্যত্বে উন্নতি ঘটায়। অন্যদিকে ভাববাদ স্বর্গ থেকে শুরু হয়ে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তাদের সীমাহীন পশুত্বের দিকে নিয়ে যায়। বস্তুবাদ মানুষের সমস্ত ইচ্ছাগুলোকে স্বীকার করে না। কিন্তু সবশেষে তা মানুষকে মুক্তির স্বাদ দেয়। ভাববাদ দাবি করে সেটি মানুষের সম্মানজনক অবস্থা চায় এবং তাদের সমস্ত ইচ্ছাগুলোকে স্বীকার করে। কিন্তু মুক্তি খুঁজতে গিয়ে সবশেষে সেখানে দেখা যায় কর্তৃপক্ষের শৃঙ্খল। বস্তুবাদ মানুষের উপর কর্তৃপক্ষের নগ্ন হস্তক্ষেপকে অস্বীকার করে। কারণ বস্তুবাদী অনুসন্ধান মতে কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করা আর পশুত্ব বরণ করে নেয়া একই কথা। বস্তুবাদীরা মনে করে ইতিহাসের লক্ষ্য এবং প্রয়োজনীয়তার সারমর্মই হলো মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে পশুত্বকে বর্জন করে মুক্তির স্বাদ লাভ করা। এক কথায়, বাস্তবে কেবল বস্তুবাদীদের কর্মগুলো করার মধ্যেই আপনি ভাববাদীদের কাজের সীমা দেখতে পাবেন।
আমি আগেই বলেছি ভাববাদীদের সিস্টেমে ইতিহাস মানুষের ক্রমাগত পতন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের স্বর্গ ভয়াবহ পতনের মধ্য দিয়ে তার ইতিহাস শুরু করেছিল। যা তারা আর মেরামত করতে পারে নি। বস্তুর মাঝে বিশুদ্ধ এবং পরম ভাব খুঁজে বস্তুকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে তারা এমন এক লাফ দিয়েছিল যে তাদের দুটো পা-ই তাতে ভেঙে গিয়েছিল। তারা এমন কোনো বস্তুতে ভাব খুঁজে নি যা বাস্তবে সক্রিয় এবং সচল। যাতে মুক্তি এবং বল দুটোই সমানতালে বিদ্যমান। যার প্রাণ এবং বুদ্ধিমত্তা আছে, অর্থাৎ যে বস্তুগুলো বাস্তব জীবনে দেখা যায়। এজন্য তারা ভাব খুঁজেছে বিমূর্ত বস্তুতে। বস্তুর সত্যিকারের সত্ত্বাকে প্রুশিয়ানদের চিন্তক, ধর্মবেত্তা ও আধিবিদ্যিকদের দ্বারা তারা দুর্বিপাক এবং দুর্দশার মাঝে ফেলে দিয়েছিল। ঐ সমস্ত লুটেরাগুলো বস্তুর মোহনীয় সত্ত্বাকে কাঁটাছেঁড়া করে তা তাদের স¤্রাট এবং ঈশ্বরের কাছে তুলে দিয়েছিল। ঐ সমস্ত শাসকদল এবং ঈশ্বর তাদের নির্বুদ্ধিতা, ভোঁতা মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয়তা এবং অচল চিন্তার মাধ্যমে বস্তুকে স্বর্গীয় বাতাবরণ দিয়ে তার সমস্ত গতি ও শক্তিকে কেড়ে নিয়ে তাকে অচল পয়সায় পরিণত করে দিয়েছিল।

এই পতন এতই ভয়াবহ ছিল যে, দৈবত্ব, দেবতা কিংবা দৈব চিন্তা অসার হয়ে গিয়েছিল। মানুষজন অচেতন হয়ে পড়েছিল। এই অচেতন হওয়ার কারণে তারা যে তীব্র নিদ্রায় ডুব দিয়েছিল তা আর কখনো ভাঙেনি। কিন্তু ঘুমানো সত্ত্বেও মানুষ তখন স্বপ্নে স্বপ্নে নানান মিরাকল ঘটাতে থাকে। চমৎকার বস্তুগত কাঠামোতে যে সমস্ত ঘটে তাদের মতে সেগুলোর সবই নাকি মিরাকল। কেবলমাত্র বস্তুর উপর ঈশ্বরের দৈব হস্তক্ষেপের কারণেই এগুলো ঘটতে পারে বলে তারা মনে করতো! সর্বোপরি ভাবের পতনে এই দৈন্য দৈবত্ব তখন ভেঙেচুড়ে বিলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিল। সহ¯্র শতাব্দী ধরে এটি মূর্ছা গিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে তা পুণঃজাগৃতির চেষ্টা চালায়। তাও ব্যর্থ হয়। তাদের অস্পষ্ট প্রচেষ্টায় এবং পরবর্তীতে বস্তুর উপর তারা যতবার খবরদারি করতে চেয়েছে তাদের প্রতিটি কাজ নতুন নতুন মিরাকল সৃষ্টি করেছে।

প্রসঙ্গত একটা উদাহরণ টানছি। যেমন একটা উদ্ভিদের কথাই ধরা যাক। একটা উদ্ভিদ প্রথমে বাষ্প, তরল কিংবা কঠিন রাসায়নিক বস্তুতে পরিণত হয়। তারপর তা সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহে ছড়াতে ছড়াতে শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে এসে পৌঁছেছে। এখন এই উপাদানগুলো কি আবার স্বরূপে ফিরে যেতে পারে? কিংবা আদৌ কি এটা সম্ভব? আগেই বলেছি এ হবে এক উল্টো পথে যাত্রা। যেটি ভাববাদীরা বারবার চেষ্টা করে থাকেন।
বস্তুগত একটি জিনিসের মধ্যে কিভাবে পুরোপুরি অবস্তুগত একটি জিনিস বাসা বাঁধতে পারে? কিভাবে শরীর বিশুদ্ধ আত্মাকে ধারণ করে নিজেকে এর ভেতর আটকে দিতে পারে? এই ধরনের প্রশ্নকে কেবলমাত্র “আত্মা” নামক এই হাস্যকর জিনিসটাই সমাধান করতে পারে। এটা মিরাকলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মিরাকল।

সহ¯্র শতাব্দীর আত্মা প্রমাণের বৃথা চেষ্টার পর স্বর্গীয় দ্যুতি নিয়ে তা আবারো নিজেকে ফিরে পেয়েছে। ধর্মবাদীরা আত্মসংযোগের মধ্য দিয়ে তাকে চিত্রিত এবং গতি প্রাপ্ত করেছে। তাদের এই তত্ত্বের মূলকথা হলো অমর আত্মা মানুষের ক্ষণস্থায়ী শরীরে অল্প সময়ের জন্য আশ্রয় নেয়। স্বর্গের প্রাচুর্যতার তুলনায় মানুষ অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং তাদের কার্যক্রমও সীমাবদ্ধ। তাদের শরীর আত্মা নামক এই বস্তুটিকে নিজের মধ্যে রাখতে পারে। কিন্তু নিখিল জগতের তুলনায় সেটি নিতান্তই ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র বস্তুটি পরমের সন্ধান প্রাপ্তির জন্য এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সর্বোপরি এর আত্মার ধারণাও একটা রহস্য। এর সমাধান বিশ্বাস করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। বিশ্বাস ছাড়া এর কোনো ভিত্তি নেই।
ঈশ্বর যদি প্রতিটি মানুষেই থাকেন তাহলে তো প্রত্যেক মানুষই ঈশ্বর হয়ে যাবেন। আমাদের তাহলে প্রচুর পরিমাণে ঈশ্বর রয়েছেন। প্রত্যেক ঈশ্বরের ক্ষমতার জন্য তাহলে অন্য সকল ঈশ্বরের প্রয়োজন এবং এক ঈশ্বর ছাড়া অন্য ঈশ্বর মূল্যহীন। অর্থাৎ এটা এমন এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে যার মাধ্যমে মানুষেরই পারস্পরিক বিনাশ ঘটছে।

বস্তুবাদীদের মতে এটা সত্য যে, মানুষের শরীরের বস্তুগত ক্রিয়ার ফলেই মনের সৃষ্টি হয়। মন বড় কিংবা ছোট হওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মনের শরীরে বস্তু কত বড় বা ছোটভাবে বিন্যস্ত হয়েছে তার উপর। কিন্তু, ভাববাদীরা মনকে যেভাবে মহিমান্বিত করে তাতে মনের এই বস্তুগত ব্যাখ্যা তাদের পছন্দ হবে না। তাদের মতে মন পরম এক সত্ত্বা এবং তা বস্তু থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মন বড় কিংবা ছোট কোনটাই হতে পারে না। মানুষের কেবলমাত্র একটিই মন থাকতে পারে- তা হলো ঈশ্বর যা দিয়েছে সেই মন। চলুন আমরা আরেকটু যাচাই বাছাই করি বিষয়টাকে।

আমরা দেখতে পাই লিঙ্গ, বয়স, জাতি এবং বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ক্ষুদ্র বস্তুকণাতেও স্বর্গ সৃষ্ট মন আশ্রয় নিয়েছে। এই মনের পক্ষে এত ক্ষুদ্র জায়গাতে নিজেকে মানিয়ে নেয়া বেশ অসুবিধাজনক। এই বিষয়টি তথাকথিত মনকে অসুখী করে। তার উপরে এই বর্বর এবং পাশবিক অবস্থায় স্বর্গীয় মন প্রাথমিক দিকে তার স্বর্গীয় অস্তিত্বের কথাই ভুলে যেতে বসে। বৃহৎ মনের এ ক্ষুদ্র পরিণতি তাদের সুখী করে না। তারা তখন আবারো সমগ্র হতে চায়। বাস্তব জগতে তখন মনের স্বর্গীয় দ্যুতি হারিয়ে যায়। মন তখন মানুষের মাঝে তার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে। “শরীর” নামক মানব কারাগারে সে নিজেকে জরাজীর্ণ অবস্থায় উদ্ধার করে নিজের মূর্খতার জন্য নিজেই নিজেকে অভিসম্পাত করতে থাকে।

বস্তুপ্রেমে মোহাগ্রস্থ মন তখন নিজেকে এক খন্ড পাথর, এক টুকরো কাপড় কিংবা কাঠের খন্ডাংশের ভজনা করে। মনের তখন এমন বোধ হতে থাকে যে এই কাপড় কিংবা কাঠের বাহিরে সে আসতে পারবে না।
এখানে উদ্ভুত হয় আরেক নতুন রহস্য- দৈবত্বের দুটি বিভাজন। এই দুই বিভাজনের প্রত্যেকটিই সমানভাবে অনন্ত অসীম সত্ত্বার অধিকারী। প্রথমটি হলো- ঈশ্বর যখন পিতা তখন তিনি অবস্থাগত জগতেই বিচরণ করেন এবং পরেরটি হলো- ঈশ্বর যখন পুত্র তখন তিনি বস্তুজগতে পতিত হন। আমরা তখন সরাসরি দেখতে পাই, এই দুই পরস্পর বিচ্ছিন্ন দৈবত্বের মধ্যে নীচ থেকে উপরে এবং উপর থেকে নীচে ক্রমাগত পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। পারস্পরিক এই আত্মিক সম্পর্কই খ্রিষ্টানদের কাছে “হলি গোস্ট” নামে পরিচিত। এর ধর্মতাত্ত্বিক ও আধিবিদ্যিক মর্মার্থ খ্রিষ্টানদের ত্রয়ী তত্ত্বের ভিত্তি বলে ধরে নেয়া হয়।

পিতারূপী ঈশ্বর পৃথিবীর উপরে নিজের জাঁকজমক দেখান। কিন্তু তার পুত্র, দরিদ্র ঈশ্বরের এই অধঃপতনে স্তম্ভিত হয়ে যান। নিজের পুত্র মানুষের শরীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে এটা দেখে ঈশ্বর তাকে পুণরুদ্ধার করার ব্রত নিয়ে নিজে পৃথিবীতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এই অমর, অসীম, স্বর্গীয়, অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলোতে ঈশ্বর পুত্র এমনভাবে নিজের সত্ত্বা হারিয়ে বসেন যে পিতারূপী ঈশ্বরও তাকে এক সময় চিনতে পারেন না। তখন ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেন তার বিরাগভাজন, তার কাছের লোক, তার সৃষ্ট সর্বোত্তম গুণের অধিকারী মানুষ অর্থাৎ নবীদের পৃথিবীতে পাঠাবেন পুত্ররূপী ঈশ্বর তথা মানুষের উদ্ধারকল্পে। একে একে তিনি জরথুস্ত্র, বুদ্ধ, মুসা, কনফুসিয়াস, সাইসুরগাস, সোলন, সক্রেটিস, প্লেটো এবং সবার শেষে যীশু খ্রিষ্টকে পৃথিবীতে পাঠান। তাদের মধ্যে তিনি ঈশ্বরের সম্পূর্ণ গুণের সন্নিবেশিত ঘটান। মানবতার সমস্ত প্রচারক এবং জনহিতৈষী ভদ্রলোকদের আগমণে পৃথিবী তখন সরগরম হয়ে যায়। সবার উপরে সেই পিটার, সেইন্টপল, সেইন্ট জন; তারপর নাম নিতে হয় কনস্ট্যানটাইন দ্য গ্রেট, মামোথ, চার্লেম্যাগনে, গ্রেগরি এবং কারো কারো মতে লুথার, ভলতেয়ার, রুশো, রবেসপিরি, ডাল্টন এবং অন্যান্য সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নামও এখানে আসবে। এদের লিস্ট এতই বিশাল যে সবার ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু আমি বলবো একজন রাশিয়ান হিসেবে সেইন্ট নিকোলাসের নাম আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

তারপর অবশেষে এসব নবীদের আগমনে পৃথিবী জুড়ে ঈশ্বরের সুবাতাস বইতে শুরু করলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এদের আবির্ভূত হবার সাথে সাথেই মানুষ অসার হয়ে পড়লো।
আমার মতে বস্তু যত ক্ষুদ্রই হোক, পরিমাণ এবং ইতিবাচকতার দিক দিয়ে তা কিন্তু স্থায়ী। বস্তুটি যত বড় হবে সেটি বাস্তবে ততই ছোট হবে। শতকোটি ক্ষুদ্র বস্তুকে শতকোটি ক্ষুদ্র বস্তু দিয়ে গুণ করলে বড় এক বস্তু গঠিত হবে যা আদতে অনেকগুলো ক্ষুদ্র বস্তুরই সমন্বিত রূপ। এই অতি ক্ষুদ্র বস্তু বাস্তবে শূণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈশ্বর সমস্ত কিছু; কিন্তু যেহেতু মানুষ, বাস্তব জগত এবং বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণার সমন্বয়ে গঠিত সেহেতু তিনি আসলে কিছুই নন।
দেখা যায় ঈশ্বর আসার সাথে সাথে মানুষ নাই হয়ে গেল। দৈবত্ব যত মহৎ হয়েছে মানবতা তত দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় পতিত হয়েছে। এটাই হলো সকল ধর্মের ইতিহাস। স্বর্গীয় আইনকানুনের নিষ্টুর ইতিহাস। অর্থাৎ ইতিহাসে ঈশ্বর হলো সেই ভয়ানক সংঘের সভাপতি, যার নাম দিয়ে স্বর্গীয় দ্যুতিপ্রাপ্ত মহৎ গুণের অধিকারী সমস্ত মহাপুরুষেরা সাধারণ মানুষের মুক্তি, সম্মান, কার্যকারণ এবং উন্নতি কেড়ে নিয়েছে।

আমরা প্রথমে স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের পতন দেখলাম। এখন আমরা এমন একটি পতন দেখতে পেলাম যেটি আমাদের আরো বেশি চিন্তিত করে তোলে। তা হলো স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের আবির্ভাবের সাথে সাথে মানুষের পতন।
দেখুন, আমাদের সুহৃদ মহিমান্বিত ভাববাদীরা কি এক ছলনা করলো আমাদের সাথে! ঈশ্বর প্রাপ্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলে আমাদেরকে উর্ধ্বাকাশে উঠাতে, উন্নত করতে মুক্তি দিতে এসে তারা আমাদের গুঁড়োগুঁড়ো করে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা ভেবেছিল যে ঈশ্বরের নাম নিয়ে তারা মানুষে সৌহার্দ বৃদ্ধি করবে। তার বিপরীতে তারা সৃষ্টি করলো মানুষের অহংকার ও ঘৃণা। তারা বপন করলো বিবাদ, ঘৃণা ও যুদ্ধের বীজ। তারা প্রতিষ্ঠা করলো দাসত্ব। ঈশ্বর বিভিন্ন ভাগে তার শিষ্যদের কৃপা করায় কিছু মানুষ হয়ে পড়লো বেশি মহিমান্বিত। কিছু মানুষ হলো কম মহিমান্বিত, আবার কিছু মানুষ কোনো মহিমা না পেয়ে হীন জীবন যাপন করতে লাগলো। এটা সত্য ঈশ্বরের প্রত্যেক সন্তানই তার কাছে সমান। কিন্তু মানুষের মাঝে তুলনা করলে কিছু সংখ্যক লোক অন্যদের থেকে মহান হয়ে গেল। এই অসাম্য সমগ্র মানবজাতিতে এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে কোনো ধরা বাঁধা ছকে একে ফেলা যায় না। স্বর্গীয় মহিমার কারণে অতি দ্রুতই এটি অসাম্য টেকসই, স্থায়ী এবং চরম রূপ লাভ করে ফেলে। উচ্চ মহিমান্বিত ব্যক্তিদের মান্য করা তখন কম মহিমান্বিত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কাজ হয়ে দাঁড়ালো। অন্যদিকে নি¤œ মহিমান্বিতদের মহিমাহীনেরা মান্য করতে বাধ্য হয়। এভাবে সমাজে কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্টিত হল এবং এর সাথে স্থাপিত হলো দাসত্বের দুই মৌলিক প্রতিষ্ঠান। একটি হলো চার্চ এবং অপরটি রাষ্ট্র।

সমস্ত স্বৈরাচারী মতবাদগুলোর মধ্যে ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ লোকদের মতবাদ সবচেয়ে বাজে। তারা ঈশ্বরের বিজয়ে এতটাই উল্লসিত হন যে মানুষের সম্মান, মুক্তি চাওয়া কিংবা মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করার মতো হৃদয় তাদের আর অবশিষ্ট থাকে না। স্বর্গীয় ভাবাবেগের প্রতি তন্ময়তা তাদের নরম আত্মাকে শুষ্ক করে তোলে। তারা মানব মুক্তির আধার স্বরূপ বিবেচিত তাদের মোহবৎসল হৃদয়কেও হারিয়ে বসেন। আত্মিক ভাব কিংবা বিমূর্ত ধারণা দিয়ে বিশ্বকে বিশ্লেষণ করার ফলে তারা বাস্তব জগতের বস্তুগুলোকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। কিন্তু বাস্তব জগতের সমস্ত মানুষ, রক্ত মাংসের সমস্ত মানুষ বস্তু দিয়েই সৃষ্টি। মানুষের দেহ নশ্বর এবং মানুষের দেহে অবস্থিত বস্তুগুলোর ক্রমাগত রূপান্তর চলতেই থাকে। একমাত্র স্থায়ী কিংবা আপেক্ষিকভাবে আত্মিক বস্তু হচ্ছে মানবতা। যার উন্নতি ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

কিন্তু এই মহাবিশ্ব মানব জাতির জন্য ভবিষ্যতে কি নিয়ে আসছে? আমরা কি জানি? জানি না। যদিও পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অনেক দূর ভবিষ্যতের ব্যাপার তাই আমাদের এ ক্ষুদ্র মানবজীবনে আমরা মানবতাকেই সত্যিকারের আত্মিক বস্তু বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু প্রগতির ধারায় এ মানবতা তখনই বাস্তব রূপ লাভ করে যখন তা তার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে সত্যিকারের মানুষের মধ্যে তার রূপ পরিগ্রহ করে।

আসলে যেকোন জিনিসের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো কেবল ঐ ঘটনার বিমূর্তায়নই প্রকাশ করে। বাস্তবে এর বিপরীতও ঘটতে পারে। এতক্ষণ আমি মানব চিন্তার পরিশিষ্টগুলো বর্ণনা করেছি। এর ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞান সেই চিন্তাগুলোর কার্যকারণ, সম্পর্ক এবং আইনকানুনের বাস্তব ভিত্তি দিতে সক্ষম। সংক্ষেপে বলতে গেলে চিন্তার ক্রমাগত রূপান্তর প্রক্রিয়া বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু সেগুলোর বস্তুগত দিক, ব্যক্তিগত দিক, যে চিন্তাগুলো অনিয়মিতভাবে আসে, যেগুলো বারবার আসে এবং যে চিন্তাগুলো মানুষের অধরা সেগুলোর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। বিজ্ঞান বাস্তব জগতের চিন্তাকে ধারণ করতে পারে। চিন্তা ব্যতীত শুধু বাস্তবকে বোঝা তার পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং জীবন নিয়ে চিন্তা বিজ্ঞানে ধরা দিলেও বিজ্ঞান জীবন দান করতে পারে না। এটাই বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এটা এর একমাত্র অনতিক্রম্য সীমাবদ্ধতা। কারণ চিন্তার উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং চিন্তাই হলো বিজ্ঞানের একমাত্র অঙ্গ।
বিজ্ঞানের এই তর্কাতীত প্রয়োজনীয়তা এবং মহান উদ্দেশ্য সত্ত্বেও এর দুর্বলতা কিংবা বলা যায় এর ধ্বংসাত্মক কাজ হলো, বিজ্ঞানের লাইসেন্সধারী সরকারি প্রতিনিধিরা কখনো কখনো জেদিভাবে বিজ্ঞানকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে দাবি করে। বিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে বস্তুগত এবং বাস্তবজীবনের কার্যকারণগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে বস্তুগত এবং সামাজিক জীবন মানবজাতির ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাধারণ নিয়মকানুনগুলো বর্ণনা করা। সোজা কথায় বলতে গেলে বিজ্ঞান প্রগতির পথে মানুষের অগ্রযাত্রার সাধারণ এবং বিশেষ ঘটনাগুলোকে মেরামত করে। আর যেগুলো মানবজাতির জন্য অকল্যাণকর বিজ্ঞান সেগুলোকে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে বাতিল করে দেয়। এক কথায় বিজ্ঞান মানবজীবনের চাবিকাঠির মতো। কিন্তু তা নিজে কখনোই জীবন নয়। বিজ্ঞান মানুষের শারিরীক কিংবা মানসিক পরিবর্তন, সামষ্টিক, সাধারণ, বিমূর্ত, অচেতন বৈশিষ্ট্যগুলোর পুণরুৎপাদন করে। সর্বতোভাবে বিজ্ঞান একটি পলায়নপার ও অস্থায়ী বস্তু বটে। কিন্তু তা অনিয়মিতভাবে মানুষের বাস্তবতা, ব্যক্তিত্ব, চৈতন্য, দুঃখ, আনন্দ, আশা, অভাব, আবেগ নিয়ে খেলা করে। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান আসলে কিছুই সৃষ্টি করে না। এটা কেবল মাত্র জীবনের আবিষ্কৃত দিকগুলো চিহ্নিত করে। প্রত্যেক কালেই বিজ্ঞান মনষ্ক লোক বিমূর্ত এই পৃথিবী থেকে সৃষ্টি হয়ে বাস্তব জগতের সাথে মিলে মিশে বসবাস করতে থাকে। বস্তুজগতে তারা যাই সৃষ্টি করে তা দরিদ্র, ভয়ংকরভাবে বিমূর্ত, রক্তহীন-জীবনহীন নতুন এক শিশু ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মানে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনকে প্রজ্জলিত করা। তাকে চালনা করা নয়।

অধ্যায় : তিন

আমরা এটা ভালো করেই জানি যে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই একজন মানুষকে খরগোশের মত ভাবতে পারেন না। এটা তার ভাবা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিজ্ঞরা ভাবেন। ভাবেন বলেই বিজ্ঞদের কাজে আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়। হস্তক্ষেপ করতে হয় এই কারণেই যেন তারা জীবন্ত মানুষকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হিসেবে না দেখে। তারা যদি মানুষের উপর ব্যর্থ হয়ে তাদের পরীক্ষণটা সমাজের উপর চালাতে যায় তাহলে সেটাকেও প্রতিহত করতে হবে। আসলে এসব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা অনেকটা ধর্মজীবিদের মতোই। যদিও তাদের সংগঠন, কুক্ষিগত বিজ্ঞান, সামাজিক জীবন সব ক্ষেত্রে তারা ধর্মজীবিদের থেকে আলাদা। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিমূর্তিকে তারা ঈশ্বর মনে করেন। এটাই তাদের সমস্যা। জীবন ও জীব তাদের কাছে যেন এক প্রকার শিকার।

বিজ্ঞান দক্ষতার সাথে বস্তুর আকৃতি দান করে। যদি কোন কিছু বাস্তব জগতে নাও থাকে তবু বিজ্ঞান আমাদের স্মৃতি, আমাদের কল্পনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে। অন্যদিকে শিল্প হলো একটি বোধ যা হাড় মাংসের শরীর ছাড়া একটি ব্যক্তিত্বকে অমর এবং চিরস্থায়ী করে তোলে। এটি একটি জলজ্যন্ত অস্তিত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের চোখের সামনেই উদিত হয় কিন্তু চোখের সামনেই আবার হারিয়ে যায়। অর্থাৎ শিল্প হলো জীবনের বিমূর্ততার ফল। সেখানে বিজ্ঞান বিমূর্ততার চেয়েও বাস্তব। যদিও বিজ্ঞানেও জীবন বলিদানের মতো বিষয় রয়েছে তারপরেও বিজ্ঞান শিল্পের চেয়েও বাস্তব।

তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, বিজ্ঞান মানুষের ব্যক্তিত্বকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে (খরগোশের ক্ষেত্রেও যা হয়েছিল)। তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞান ব্যক্তিত্বের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ। এটি ব্যক্তিত্বকে পদ্ধতি হিসেবেই নিয়েছে, সত্য হিসেবে নয়। এটি ভালো মতই জানে যে মানুষের মত অন্যান্য প্রজাতিরও জনসংখ্যা ছাড়া কোনো অস্তিত্ব নেই। এরা সকলেই জন্ম নেয় এবং মৃত্যু বরণ করে। এটি জানে যে নি¤œ স্তর থেকে উঁচু স্তরের প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের মন্ত্র বেশি উচ্চারিত হয়। উঁচু স্তরের প্রাণীর সত্ত্বা তখন আরো মুক্ত ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি জানে মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ জীব। সবচেয়ে পরিপূর্ণ এবং স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কারণ মানুষের কল্পনা করার বাস্তব ও মূর্ত হবার শক্তি আছে। এটি জানে মানুষের প্রতি ভালোবাসাই মানবতার সর্বোচ্চ আইন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এই শিক্ষার একমাত্র বৈধ উদ্দেশ্য হলো মানবিকীকরণ ও বন্ধন থেকে মুক্তি, প্রকৃত স্বাধীনতা, প্রত্যেক মানুষের সামাজিক সুখ ও সমৃদ্ধি। এজন্য রাষ্ট্রের পরিচালিত গণসচেতনতামূলক স্বাধীনতানাশী অলীক গল্পে বিশ্বাস করা ঠিক না। তারা আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন বুঝাতে চাইবে। কিন্তু আমাদের সবাইকে সামগ্রিক স্বাধীনতা এবং উন্নতিকে উপলব্ধি করতে হবে। যেটাকে রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতা ও উন্নতি দিয়ে প্রকাশ করে।

বিজ্ঞান এসকল কিছুই জানে। তবে সমস্যাটা হলো এটি এর বাইরের কিছু জানেও না, জানতে পারেও না। বিজ্ঞান বাস্তব ও জীবন্ত ব্যক্তিত্বের মন্ত্র সম্পর্কে ভালো মতন বুঝতে পারে। কিন্তু বাস্তব ও জীব জগতের সম্পর্কে এর কোনো ধারণা নেই। এটি সাধারণত জীবজগত সম্পর্কে কাজ করে কিন্তু পিটার বা জেমস নিয়ে নয়। এর সত্ত্বারা বিমূর্ত।

এখন ইতিহাস আবার বিমূর্ত সত্ত্বা দিয়ে তৈরি হয় না। তৈরি হয় জীবন ধারণ, কাজকর্ম ও গতিশীল মানুষ দ্বারা। ফলে ইতিহাসে এটি নিজের স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়। বাস্তব মানুষদের উৎপত্তির ফলে বিমূর্তন এগিয়ে চলে বিজ্ঞানের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের কাছে মানুষ বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক উন্নতির বস্তু। পিটার অথবা জেমসের অবস্থা কিংবা ভাগ্য নিয়ে ভাবা এটির কাজ নয়। বিজ্ঞানের কাছে এটি হাস্যকর। যদি বিজ্ঞানকে তার চিরায়ত কোন সূত্রের বাইরে আসতে বলা হয় তাহলে বিজ্ঞান সেটিকে পরিত্যাগ করবে, ধ্বংস করতেও দ্বিধা বোধ করবে না। আর যেহেতু এটা তার উদ্দেশ্য নয়, সেহেতু বিজ্ঞানের কাছে এরকম আশা করাও বোকামি । বিজ্ঞান বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারে না। এটি শুধু বিমূর্ততার মধ্যে ঘোরে। এর লক্ষ্য সাধারণ অবস্থার অস্তিত্ব ও উন্নতি নিয়ে ব্যস্ত থাকা। মনুষ্য প্রজাতি, অথবা অন্য কোন প্রজাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকা। উন্নতি, অবনতি এবং উন্নতির সর্বশ্রেষ্ট নিরাপদ পদ্ধতির সাধারণ কারণ খুঁজে বের করা। কাজটিকে বাস্তবসম্মত ও বিস্তৃতভাবে সম্পন্ন করে বিজ্ঞান তার দায়িত্ব পালন করে। বিজ্ঞানের কাছে এর চেয়ে বেশি আশা করা সমীচীন নয়। এর কাছে এমন কিছু আশা করা হাস্যকর এবং বিপদজনক যা সে দিতে পারে না। যেহেতু এর উদ্দেশ্য পিটার ও জেমসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এটি পিটার ও জেমকে খরগোশের মতই বিবেচনা করে এবং এই কারণেই তাদের অস্বীকার করে।

পক্ষান্তরে এটি নানান ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে মানুষের উপর অপ্রতিরোধ্য বিশেষ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ঠিক যেমন এ যাবৎ বিভিন্ন ধার্মিক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ঈশ্বর, রাষ্ট্র অথবা আদালতের নাম ভাঙিয়ে মানুষকে ঠকিয়েছে, তেমনি এই বিজ্ঞ ব্যক্তিরাও মানুষকে ঠকায়।

আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি- বিজ্ঞানের এত ক্ষতিকর প্রভাব সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট পরিসরে জীবনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের বিদ্রোহ অথবা বিজ্ঞানময় সরকারের বিদ্রোহ যাই বলি বিজ্ঞানকে ধ্বংস করা যাবে না। যদি করা হয় তাহলে এটাই হবে মানবতার বিরুদ্ধে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। বিজ্ঞানকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে যেখানে এটি আগে ছিল। এটাই সমাধান।

এখন পর্যন্ত মানব জাতির ইতিহাসে ঈশ্বর, দেশ, রাষ্ট্রক্ষমতা, জাত্যাভিমান, ঐতিহাসিক অধিকার, বিচারিক অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণউন্নয়ন সবই সৃষ্টি হয়েছে জঘণ্য বলিদানের মাধ্যমে। এগুলো আজ প্রাকৃতিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা এগুলোকে বাতিল করতে পারবো না। আমাদের এগুলোকে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতই মনে করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে এগুলো মানব জাতিকে শিক্ষা দেয়ার একমাত্র সম্ভাব্য উপায় ছিল। সুতরাং আমাদের সত্যটা বুঝতে হবে। ম্যাকিয়াভেলীয় মনোরম কৌশলের শাসকশ্রেণীর গর্বিত অংশ হয়েও আমাদের স্বীকার করতে হবে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে এসব ভয়ংকর কর্মকান্ড চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। তাহলে এটি হবে ইতিহাসের আরেকটি সর্বগ্রাসী বিমূর্ততা যা মানবজাতিকে রক্তগঙ্গায় নরপিশাচের মত প্রবাহিত করবে।

আমরা বুঝতে পারছি এই রক্তগঙ্গা ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ এবং বিচারকের কাছে সন্তোষজনক। কারণ ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ এবং বিচারকেরা এই রক্তগঙ্গার উপরই বেঁচে আছেন। অধিবিদ্যা নিজেও এতে সম্মতি জানিয়েছে। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য অন্যায় ও কুযুক্তিকে প্রমাণ ও যুক্তিকে গ্রাহ্য করা।

কিন্তু এর বিপরীতে বিজ্ঞান তার এমন রূপ দেখিয়েছে যে একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আক্ষেপ করতে হয়। প্রথমত, কিছু সুবিধাভোগী মানুষ জীবনের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানকে প্রকাশ করে এবং দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান নিজেকে মানব উন্নয়নের চরম ও সর্বশ্রেষ্ট উদ্দেশ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই যা সমস্যা।

ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, রাজনীতি এবং বিচারিক আকারের চেয়ে বিমূর্ত বিজ্ঞানের বিশাল সুবিধা এই যে, এসব মতবাদের মিথ্যা ও মারাত্মক বিমূর্ততার জায়গায় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করে সত্য বিমূর্ততা। এসব বিমূর্ততা বস্তুর গতি প্রকৃতি ও কার্যকারণ প্রকাশ করে। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক ও উন্নতির সূত্র প্রদান করে। এটি পূর্ববর্তী মতবাদগুলোকে দক্ষতার সাথে আলাদা করে এবং নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এটি সমাজের সামগ্রিক সচেতনতার একটি বোধ তৈরি করে। সবকিছুকে বিমূর্ত রাখা উদ্দেশ্য নিয়ে এটি সব মতবাদকে এক করে দেয়। এটি প্রকৃতিগতভাবে ব্যক্তিবাদকেও উপেক্ষা করে।

প্রাথমিক এই ভুলটিকে শুধরানেরা জন্য পজিটিভ বিজ্ঞানকে (যে বিজ্ঞান এরিস্টটলের সময় থেকে চলে আসছে) তার অতীতের মতবাদ ঝেড়ে নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। তার মধ্যে ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান এটি পারবে না। সাধারণের অজ্ঞতাকে গর্বের সাথে বিমূর্ততার মাধ্যমে বলি দেয়ার একটা প্রকট সম্ভাবনা সেখানে থেকে যায়। অনেকে সত্য বিজ্ঞানের কথাও বলতে পারেন। একটি বার ভাবুন তো, এটি আমাদের সর্বোচ্চ কি দিতে পারে? এটি সাধারণ অবস্থার প্রাকৃতিক উন্নতির একটি বিশ্বাসযোগ্য ও কারণসম্মত ছবি, বস্তু ও আদর্শ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক, ধর্মীয়, দার্শনিক, নান্দনিক ও বৈজ্ঞানিকসহ সমাজের ইতিহাস সম্বলিত উপাদান প্রদর্শন করতো। এই তো। তাও আবার বিমূর্ত ধারণার মধ্যে। শতকোটি মানুষের যারা ইতিহাসে বেঁচে থাকার ও সংগ্রামের সামগ্রী সাজিয়েছে বিজয়ী দলের মাধ্যমে ও বিজিত মানব শিকারের অসহায় বলির মাধ্যমে তা সেখানে চাপা পড়ে গেছে। অথচ সেই মানুষগুলোকে ছাড়া বিমূর্ত পৃথিবীর ইতিহাস লেখা সম্ভব হত না। কিন্তু এই মানুষগুলো এই সব লড়াই থেকে কোন রকম উপকৃত হয় নি, কোন ইতিহাসেও তাদের নাম নেই। তারা শুধু ত্যাগ করেছে, চূর্ণ হয়েছে বিমূর্ত মানবতার জন্য।
তাই সমাধানটা পজিটিভ বিজ্ঞানের সংস্কারের মধ্যেই নিহিত।

আমরা কি ইতিহাসের বিজ্ঞানকে দোষ দিবো? না। দোষ দিলে সেটি হবে অন্যায় ও হাস্যকর। আমরা আশা করি যে বিজ্ঞান জীবের সংগ্রামের সাধারণ কারণগুলোতে বিশ্বাসযোগ্য ও নিশ্চিতভাবে মনোযোগ দিবে। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে বিজ্ঞানই আমাদের সমাজের জীবন্ত মানুষের প্রকৃত মুক্তির প্রয়োজনীয় সাধারণ শর্তসমূহ প্রকাশ করে। এটাই এর মিশন। এর বাইরে বিজ্ঞান নিষ্ক্রিয় ও মারাত্মক- এটাই এর সীমাব্ধতা। এই বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে।
বিজ্ঞান আমাদের আলোর সন্ধান দিতে চায়। কিন্তু বাস্তব জীবন আবার এটি চায় না। আবার বিজ্ঞান তার প্রচারের জন্য যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় বাস্তব জীবন তার সমাধান দেয়। মাঝে মাঝে বিজ্ঞান ও বাস্তব জীবন এই দুই মতবিরোধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো বিজ্ঞান ও বাস্তব জীবনের এই মতবিরোধের সমাধান হবে কিভাবে?

এই স্ববিরোধ কেবল একভাবেই সমাধান করা যায়। আর সেটা হলো অস্তিত্বমান সবকিছুর জীবনের নৈতিক সত্ত্বা হিসেবে বিজ্ঞানের দেনা পরিশোধ এবং অবেতনভুক্ত জ্ঞানীদের (সাধারণ জনগণের যারা স্বেচ্ছায় বিজ্ঞান মনষ্ক হয়ে কাজ করে) দ্বারা তার বহিঃপ্রকাশ করে জনসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেয়া। একে সমাজের সামগ্রিক সচেতনতার কথা তুলে ধরতে হবে। তারপর বিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে সকলের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। যেখানে এটি কেবল মাত্র বস্তু এবং প্রাণীর সাধারণ কার্যকারণ, অবস্থা ও নির্দিষ্ট সস্পর্ক নিয়ে নিজেকে বিবেচনা করছে, যেখানে এটি সব জীবের বর্তমান ও বাস্তব জীবনের একটি সত্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি হবে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের মত একটি সংস্কার যেখানে প্রোটেস্ট্যান্টরা দাবি করেছিল তাদের কোনো ধর্মযাজকের প্রয়োজন নেই, তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিজস্ব যাজক।

কিন্তু যতক্ষণ না জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করা হবে, তাদের কি বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিবর্গ সম্বলিত সেই সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া জরুরি? অবশ্যই না। বিজ্ঞদের দ্বারা শাসিত হবার চাইতে বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করা উত্তম। প্রথমে এই সরকার বিজ্ঞানকে জনগণকে কাছে দুষ্প্রাপ্য করে দিবে এবং দ্বিতীয়ত তারা একটি অভিজাত সরকার গঠন করে বিজ্ঞানকে করে তুলবে রাজসিক! বিষয়টা বাস্তবিকভাবে খুব নির্দয়! আর সামাজিকভাবে দেখলে সবচেয়ে উন্নত ও অপমানজনক অবস্থা। মূলত এভাবেই বিজ্ঞান তার ক্ষমতার ছড়ি ঘুরাবে। এরকম শাসনব্যবস্থা সমাজের প্রাণ ও আন্দোলনকে অবশ করে তুলবে। এসব বিজ্ঞরা সবসময়ই বেয়াদব, সামলম্বী এবং সবচেয়ে বেশি নিষ্ক্রিয়। সবকিছুকে তারা বিমূর্ততার নিচে শুকিয়ে দেয়।

আসলে বিজ্ঞান নয়, জীবনই জীবন তৈরি করে। মানুষের নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত কাজই মানুষের মুক্তি আনে। যদি বিজ্ঞান আজ থেকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি বিজ্ঞানের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তথাকথিত বিজ্ঞদের নিকট মাথা নত করা যাবে না। তাদের মিথ্যা ও অকল্পনীয় আলোর চাইতে আলোর অনুপস্থিতি ভালো। এটি অন্তত কাউকে পথভ্রষ্ট করবে না। তবে চলার পথে মানুষের আলোর অভাব হওয়ার কথা নয়। মানুষ হয়তো সেই পথে কোন পারিশ্রমিক পাবে না, কিন্তু বাস্তব জীবনের কষ্টময় অভিজ্ঞতাগুলোকে মিলিয়ে তারা একটি গতানুগতিক মামুলি বিজ্ঞানের সন্ধান পাবে যার মূল্য কখনোই তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের চেয়ে কম নয়। বরং বেশি। তখন হয়তো দেখা যাবে বুর্জোয়া ছাত্ররা বুর্জোয়াদের মিথ্যাচার, ভন্ডামি, অবিচার ও কাপুরুষতাকে ঘৃণা করে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস করবে, অকপটভাবে প্রলেতারিয়েতের প্রতি অবিচার স্বীকার করবে। তখন তারাই হয়ে যাবে জনগণের ভ্রাতৃসুলভ পথপ্রদর্শক। তাও তাদেরকে ধন্যবাদ। কিন্তু তারপরেও ঐ বিজ্ঞদের সরকার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

যদি জনগণ বিজ্ঞদের এই সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক থাকে, আদর্শবাদীদের চেয়েও তারা বেশি আন্দোলন করতে পারবে। আসলে স্বর্গের কবি এবং বিশ্বাসীদের সংখ্যা যত বাড়ে, তারা ততই ভয়ংকর হয়ে উঠে। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক বিমূর্ততা হলো যুক্তিসম্মত বিমূর্ততা। এটি সত্য সত্ত্বা, জীবনের জন্য দরকারি কিন্তু এটি জীবনের তত্ত্বীয় উপস্থাপনা। একে প্রাণের মাধ্যমে শোষণ ও হজম করতে হবে। কিন্তু আদর্শবাদী বিমূর্ততা জীবনকে ধ্বংস করে, হত্যা করে।
ভাববাদীদের গর্ব, তারা ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয়। তারা পবিত্র, অপরাজেয় ও পরিবর্তনশীল। কিন্তু সর্বশেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এটি মানুষকে ঈশ্বরের কাছে বলি দিবে। যেরকম করেছিল প্রুশিয়ার লেফটেন্যান্ট।

আসলে মানুষ প্রকৃতির অন্যান্য জিনিসের মতই, পুরোপুরি একটি বস্তুগত সত্তা। মানুষের মন, চিন্তার দক্ষতা, বিভিন্ন অন্তর্গত ও বাহ্যিক চেতনা গ্রহণ ও বোঝার ক্ষেত্রে কল্পনার মাধ্যমে চেতনাকে বাড়িয়ে তোলা, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য খুঁজে বের করা, সদৃশ বিমূর্ততা নিরূপন করা ও এর মাধ্যমে সাধারণ মতবাদ তৈরি করা এবং সবশেষে মতবাদের বিন্যাস ও সমন্বয়ের মাধ্যমে ধারণা প্রতিষ্ঠা করা- এককথায়, আমাদের ¯্রষ্টা এবং আদর্শ পৃথিবী, প্রাণীর এবং মস্তিষ্কও বস্তুগত সম্পত্তি।

আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে এসব ভালো করেই জানি, কোনো সত্ত্বা এর বিরোধিতা করে নি। যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে তা যাচাই করতে পারবে। সকল জীবেই আমরা বুদ্ধির একটি ক্রম দেখতে পাই। আর প্রজাতির সিরিজে প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করা হয় মানুষের মত করে। তাদের উন্নতি হয় মানুষের মত। কিন্তু একমাত্র মানুষেরই বিমূর্ততার শক্তি আছে যা তার চিন্তা ভাবনা গুলো গঠন করে।

আমাদের জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র ও উৎস হলো বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা। বুদ্ধিমত্তা থেকেই এই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। আর এই বুদ্ধিমত্তার তীব্রতা, শক্তি আর ক্রিয়া কলাপ নির্ভর করে প্রাণীর আপেক্ষিক খুঁতবিহীনতার উপর। এই বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার ফলাফলের আধুনিকতম রূপটি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীতে প্রয়োগযোগ্য নয়। আমরা মানুষের মতো করে একে প্রতিষ্ঠা করি। এই বুদ্ধিমত্তাই নির্ধারণ করে একটি প্রাণী কতটুকু ভুল বা সঠিক।

অন্যভাবে বলা যায়, কেউই বিশুদ্ধ মন দেখে নি বা দেখতে পারে নি যা তার শরীর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন কিছু। কিন্তু যদি কেউই একে বাস্তবে না দেখে থাকে মানুষ কিভাবে মনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে? এই বিশ্বাসের পেছনের সত্যটা বিশ্বজনীন না হলেও ভাববাদীদের মতই খুব সরল আর তা হলো এটি আমাদের খুবই আপন কিছু। সাধারণ বিশ্বাস বোকার মত হলেও এটি মানুষের প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ধাক্কা দেয় এবং মনকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে আমাদের সাবধান করে দেয়।

এই বিশ্বাসের ব্যাখ্যাটি যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। এটি বুঝিয়ে দেয় মানুষ তার মানসিক দক্ষতা সম্পর্কে জানার আগেই একে ব্যবহার করা শুরু করে। মনের অবচেতন এই কাজের সময়, নিষ্পাপ কাজ অথবা বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বাসের সময় মানুষ বাহ্যিক জগতের বিভ্রমে পড়ে যায়। যা তাকে জীবন নামের অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনায় চালিত করে। জীবনও নানাবিদ প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণে কল্পনা, ধারণা ও চিন্তার সৃষ্টি করে (যেগুলোতে প্রথমে ভুল থাকে) এবং পরবর্তীতে জগতে বাস্তবতাকে মেনে নেয়। এগুলোকে সে প্রকাশের চেষ্টা করে। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড সম্পর্কে সচেতন না হয়ে নিজের কল্পনাশক্তি সম্পর্কে না জেনে এই চিন্তা ভাবনাগুলো ব্যক্তিকে (সাবজেক্ট) বাতিল করে দেয়। স্বভাবতই মনে করে সবকিছু বস্তুনিষ্ট(অবজেক্ট)। বাস্তব সত্ত্বার মতই চিন্তাগুলো মানুষ থেকে স্বাধীন, মানুষ থেকে উদ্ভুত এবং থাকে মানুষের ভিতর।

একটি বারও কি ভেবেছেন যে কবে থেকে এরকমটি শুরু হলো? আসলে আদিম মানুষেরা যখন থেকে প্রাণীর নির্মলতা ছেড়ে ঈশ্বরের আরাধনা শুরু করে তখন থেকেই এরকম হচ্ছে। তারাই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে, ঈশ্বরকে কোনো রকম সন্দেহ না করে তারা পূজা শুরু করে দেয়, ঈশ্বরকে নিজেদের থেকেও শক্তিশালী ভাবা শুরু করে তাকে সর্বশক্তি অর্পন করে দেয়। আর নিজেদের বানিয়ে ফেলে ঈশ্বরের সৃষ্টি, ঈশ্বরের গোলাম। যতই দ্রুত মানুষের চিন্তা উন্নত হতে লাগলো তারা ঈশ্বরকে আদর্শ মনে করতে থাকে। যে ঈশ্বর বাস্তব দৃশ্যমান জগতে বাস করতো না সেই ঈশ্বরই হয়ে গেল তাদের আদর্শ। সবশেষে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে সেই ঈশ্বর হয়ে যায় পবিত্র একক সত্ত্বা, চিরায়ত পরম আত্মা, বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এবং মহারাজা!

এই ভয়ংকর ধর্মীয় উন্মাদনার ঐতিহাসিক অগ্রগতি আমাদের চূর্ণ বিচূর্ণ করে পৃথিবীর বাইরে পাঠিয়ে দিতে চায়। উন্মাদনার এই ধাপটি শরীরবৃত্তীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই স্বাভাবিক এবং একই সাথে মানবতার ইতিহাসের জন্য খুবই দরকারি। আমি ঠিক জানি না কত শতাব্দী ধরে এই বিশ্বাসটি বড় হয়ে মানুষের প্রথায় পরিণত হয়ে মানুষকে পরিচালিত করছে। কিন্তু একবার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এটি মানব সমাজে ঘাঁটি গেড়ে বসে। যেভাবে একজন পাগল একজন সুস্থ মানুষের মস্তিষ্ক দখল নিয়ে নেয় ঠিক সেভাবে। একজন পাগলকে দেখুন, তার পাগলামির কারণ কারণ যাই হোক, দেখা যায় এক নির্দিষ্ট ও অজানা চিন্তা তাকে সব সময় মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। এই ধর্মীয় উন্মাদনাও আমাদের এরকম মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।

যাক, ধর্ম হলো একটি সামগ্রিক অসুস্থতা। এটি খুবই শক্তিশালী। কারণ এটি বংশ পরম্পরায় চলমান মূর্খতা। কারণ এর উৎপত্তিস্থান কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। এর সামগ্রিক উন্মাদনা সমাজের রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে প্রবেশ করার কারণে সমাজের মধ্যে এটি দেহ ধারণ করেছে। সত্য কথা বলতে, এটি সমষ্টিগত আত্মা ও চিন্তায় পরিণত হয়েছে। জন্মের পরই প্রত্যেকে এর খাঁচায় আটকে পড়ে। মাতৃদুগ্ধ পানের সময়ও একটা শিশু ধর্মের রস আস্বাদন করে। সে যাই দেখে কিংবা স্পর্শ করে সবখানেই সে ধর্মকে খুঁজে পায়। এতে সে মারাত্মক হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বিষাক্ত ও মর্মভেদি প্রথাকে ভাঙার জন্য দরকার হয় ভয়ংকর প্রলয় ও বিদ্রোহ। যা তার শক্তিশালী মনের পক্ষেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। আমরা আধুনিক ভাববাদীদের অনেক দেখেছি। আরো দেখেছি আমাদের বস্তুবাদী তত্ত্ব- জার্মান কমিউনিজমে। কিন্তু তারা রাষ্ট্রের ধর্ম দূর করার মত কোন উপায়ই শেষ পর্যন্ত বের করতে পারে নি।

মানুষের কল্পনায় সুপ্রতিষ্টিত হবার পর এসব ধর্মীয় সিস্টেমের অগ্রগতি প্রাকৃতিক ও যৌক্তিক পথ অনুসরণ করে। সকল যুগের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কও এই অগ্রগতি মেনে নেয়। মেনে নিয়ে তারা ধর্মীয় খামখেয়ালী, বিশ্বাস উৎপাদন ও পবিত্র উৎসর্গের জন্ম দেয়। এভাবে বস্তুকামের মাধ্যমে ধর্মের নাম দিয়ে সমষ্টিগত ও ঐতিহাসিক পাগলামি, বহু ঈশ্বরবাদ থেকে খ্রিষ্টীয় একেশ্বরবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

ধীরে ধীরে বহু ঈশ্বরবাদিতা থেকে তখন একেশ্বরবাদিতায় রূপান্তর ঘটে। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের অগ্রগতির দ্বিতীয় ধাপ। প্যাগানদের ধর্মীয় বস্তুবাদ থেকে তখন খ্রিষ্টধর্মের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের আগমণ ঘটে। প্যাগান দেব দেবীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো তাদের জাতীয়তা। তারা ছিল জাতীয় দেবতা। মানুষ তাদের প্রয়োজনে হাজারো দেবতাকে মনে রাখতো। প্যাগান দেবতারা বাস্তবতাকে কঠোরভাবে অস্বীকার করতো না। সর্বোপরি বস্তুগত হওয়ার কারণে তারা ছিল সমৃদ্ধ। বৈচিত্রময় সত্ত্বা ছিল তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু এই আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে সংগ্রামও কিন্তু কম ছিল না। এর জন্য ইহুদীদের যে কি মূল্য দিতে হয়েছে তা আমরা সকলে দেখেছি। আমরা দেখেছি কিভাবে মুসা সহ অন্যান্য নবীদের বার্তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল। জনসাধারণ আবার তাদের প্রতিমা পূজায় ফিরে গিয়েছিল। ফিরে গিয়েছিল প্রাচীন ও আরো বেশি স্বাভাবিক ও সুবিধাজনক ভালো দেবতায়। আরো বেশি বস্তুগত ধারণায়, যাদেরকে স্পর্শ করা যায়। তারপরেও জিহোবাই সবসময় তাদের প্রকৃত ঈশ্বর ছিলেন। মুসা সহ অন্যান্য নবীদের এই ঈশ্বর ছিলেন পুরোপুরি তাদের জাতীয় ঈশ্বর। ইহুদীদের এই ঈশ্বর অবশ্য অন্যান্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব কখনো অস্বীকার করেন নি। তবে তিনি আসলে চাইতেন না তার অনুসারীরা তার পাশাপাশি অন্য কারো আরাধনা করুক কারণ জিহোবা ছিলেন খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। তার প্রথম হুকুমটি ছিল- “আমিই তোমাদের রাজা ও ঈশ্বর এবং আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ঈশ্বর নেই।”

তারপর জিহোবা ছিলেন একজন খুবই বস্তুগত ও কর্কষ আধুনিক ভাববাদের প্রথম খসড়া। আবার তিনি ছিলেন একজন জাতীয় ঈশ্বর। জার্মান ঈশ্বরকে বার্লিনের রাজা প্রথম উইলিয়াম, তার ভক্ত ও জার্মান জেনারেলরা নিজেদের ঈশ্বর বলে প্রচার করতো। কিন্তু পরম সত্ত্বা কি কখনো জাতীয় ঈশ্বর হতে পারে না? তিনি তো অবশ্যই পুরো মানবতার ঈশ্বর হবেন। পরম সত্তা কখনোই বস্তুগত হতে পারেন না। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে তখন ঈশ্বর “জাতীয়” হয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন মানুষজন পরম সত্ত্বাকে আরাধনা করার জন্য দুটি জিনিসকে বুঝেছিলঃ
১. জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি এবং আরাধনার মাধ্যমে মানবতার বোধ জাগ্রত করা।
২. অধিবিদ্যাগত ধ্যান ধারণার অধিক উন্নতির জন্য স্থ’ূল ঈশ্বরের আত্ম শুদ্ধিকরণ।

প্রথম শর্তটি পূরণ করেছিল রোমানরা। অধিকাংশ প্রাচীন দেশগুলোকে বশে এনে এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে তাদের এ কাজটি করতে হয়েছিল। বিজয়ী দেশের দেবতারা জড়ো হতো সূর্যদেবের মন্দিরে এবং একে অন্যকে বাতিল করে দিতো। এটিই ছিল মানবতার সর্বপ্রথম ¯ূ’’ল ও নেতিবাচক খসড়া।

দ্বিতীয় শর্তটি অর্থাৎ জিহোবার আধ্যাত্মিকীকরণ প্রথমত বুঝতে পেরেছিলো গ্রিকরা। যখন তারা রোমানদের হাতে সা¤্রাজ্য খোয়ায় নি সেই সময়টিতে। তারাই ছিল অধিবিদ্যার ¯্রষ্টা।
ইতিহাসের শুরুতে গ্রীস এবং ওরিয়েন্ট অঞ্চল(পূর্ব এশিয়া) একটি পবিত্র জগতের সন্ধান পেয়েছিল। যেটি মানুষজনের চিরায়ত বিশ্বাসের উপর চলতো। পরবর্তীতে ওরিয়েন্টরা এই পবিত্র জগতের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসে। পরবর্তীতে গ্রীকরাই এটাকে ধরে রাখে। গ্রিসে রাজনৈতিক নানান প্রক্রিয়া শুরু হবার আগেই তারা তাদের কবিদের মাধ্যমে এই পবিত্র জগতকে উন্নত করে প্রকান্ড মানবিক করে তুলে। ধীরে ধীরে এটি তাদের কাছে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী এবং মহান ধর্ম হয়ে গেল। কিছু গ্রিক চিন্তাবিদও তখন এই পবিত্র জগতটিকে প্রতিষ্টিত করতে ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনসাধারণরা শুধু যে একে বিশ্বাস করতো তাই নয়, এটি তাদের অনুভব ও চিন্তা ভাবনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তারা একে অগস্ত্য যাত্রার মতো উপযুক্ত বিষয় হিসেবে মনে করলো।

প্লেটোর মত মহান প্রতিভাবান ব্যক্তিও পর্যন্ত এই পবিত্র জগতের ধারণাটি দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, ধর্ম এতটাই ছোঁয়াচে, এতটাই শক্তিশালী যে এর উন্মত্ততা মহৎ মনের উপরও তার প্রভাব ফেলে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সর্বকালের সেরা দার্শনিকেরা (!) এরিস্টটল ও প্লেটোর সময় থেকেই এই পবিত্র জগতের ধারণাটি তাদের অতিন্দ্রিয় ও স্বর্গীয় মুকুটে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন হেগেল। কান্টের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি এই ত্রুটিযুক্ত ও অতি দার্শনিক চিন্তা দিয়ে পবিত্র জগতের ধারণার নৈব্যক্তিকতা ও বাস্তবতাকে ভুল প্রমাণ করেছিলেন। তবে পাশাপাশি এটাও সত্য যে, হেগেল তার এই কাজটি এতই বাজেভাবে করেছিলেন যে, তিনি ঈশ্বরকে চিরতরে মেরে ফেলছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন মানুষ তার মনের চলমান ঐতিহাসিক সৃষ্টির বেশি কিছু নয়। এইসব ধর্মের পাগলামি ও পবিত্র মরীচিকা বন্ধ করতে তিনি যে কথাটি বলতে চেয়েছিলেন তা তার পরবর্তী আরো দুজন দার্শনিকও বলেছিলেন। দুজন দার্শনিক প্রায় একই সময়ের ছিলেন। একই সময়ের হলেও দুজনের কেউই একে অপরকে চিতেন না। একজন ছিলেন হেগেলের শিষ্য ও হেগেলকে ধ্বংসকারী লুডভিগ ফয়েরবাখ। অপরজন পজিটিভ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ। তাদের বাণীগুলো ছিলো এরকম-

“অধিবিদ্যা মনস্তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। অধিবিদ্যার সকল শাখা কালের বিবর্তনে এখন মনস্তত্ত্বের অগ্রগতির সাথে মিলে গেছে।”

বর্তমানে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, কিভাবে এই ধর্মীয় পবিত্রতার ধারণাটি আসলো এবং কিভাবে বংশ পরম্পরায় তারা মানুষের বিমূর্ত দক্ষতায় তৈরি হয়েছিলো। আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্লেটোর সময় এগুলো ভাবা সম্ভব ছিলো না। সমষ্টিগত মন হোক কিংবা একক মানুষের মন হোক বা কোন মহৎ মন হোক - কেউই এ কথা মেনে নেয়ার মত শক্ত ছিলো না। তবে সেই সময় সবাইকে ছাপিয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন সক্রেটিস। তিনি বলেছিলেন- “নিজেকে জানো।”

কিন্তু তখন মানুষের মনের পক্ষে এটির মর্মার্থ বোঝা অসম্ভব ছিলো। তাদের কেউই বুঝতে পারেন নি এখানে ঈশ্বরকেন্দ্রিক চিন্তার কারণ অনুসন্ধানের আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু মানুষের মন যে আগেই পবিত্র জগতের সন্ধান পেয়েছিল। তাদের সেই মন সক্রেটিসের বাণীকে ইতিহাস হিসেবে, ঐতিহ্য হিসেবে, আবেগ হিসেবে এমনকি চিন্তার অভ্যাস হিসেবে দেখেছিল। তারা শেষমেষ একে বানিয়ে ফেললো অতি মহিমান্বিত অলীক কিছুর লক্ষ্য বস্তু। এভাবেই জন্ম হয় অধিবিদ্যা বা দর্শনের। পবিত্রতার ধারণাকে তখর উন্নত করে পরে একে আরো নিখুঁত করা হয়। ফলে দর্শন হয়ে যায় আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি।

এত কিছুর পরেও এটা সত্য যে প্লেটোর পরে মননের কিছুটা উল্টোগামী পরিবর্তন হয়। যেমন এরিস্টটলের কথাই ধরা যায়। এরিস্টটল (বিজ্ঞান ও পজেটিভ দর্শনের জনক) পবিত্র জগতকে বাতিল করে দেন নি। কিন্তু এ ব্যাপারে যতটা সম্ভব কম কথা বলেছিলেন। বিশ্লেষক এবং পরীক্ষকের মত তিনিই প্রথম বের করেছিলেন যে, যুক্তি হলো মানুষের চিন্তার আইন। আর একই সাথে তিনি বলেছিলেন এই পার্থিব জগত কোনো আদর্শ নয়, এটি একটি মোহনীয় সত্ত্বা। এরও বাস্তব একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এরিস্টটল বিষয়টাকে এরকমই দেখতেন।

পরবর্তীতে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রীকরা পজিটিভ বিজ্ঞানের প্রথম স্কুল স্থাপন করেন। যারা এটি স্থাপন করেছিলেন তাদের সকলেই ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু তাদের নাস্তিকতাবাদ সমসাময়িকদের উপর কোনো ছাপ ফেলতে পারে নি। ফলে বিজ্ঞান নিজেকে জীবন থেকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।

কিন্তু তখনই আবির্ভাব ঘটে এপিকিউরিয়ান সংশয়বাদীদের। মূলত তাদের কারণেই প্লেটোর পর পবিত্র ধারণাগুলো দর্শনের মধ্যে নিজে থেকেই বাতিল হয়ে যাচ্ছিলো।
আলেকজান্দ্রিয়ার আরেকটি স্কুলের প্রভাব ছিলো আরো অনেক বেশি। এটি ছিলো নব্য প্লেটোনিকদের স্কুল। এরাই ছিলো খ্রিষ্টীয় মতবাদের জন্মদাতা এবং পরবর্তীতে এর ব্যাখ্যা কারক। এরাই ওরিয়েন্ট ও প্লেটোর ধারণা নিয়ে বীভৎস কল্পনার এক ভেজাল মিশ্রণ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলো।

এদের হাত ধরে জিহোবা তখন ব্যক্তিবাদী ও অহংকারী হয়ে ওঠেন। তার এই অহংকার ও ব্যক্তিবাদ রোমানদের রাজ্য জয়ের চেয়ে কোনো অর্থেই কম নিষ্ঠুর ছিলো না। তখন গ্রীকদের আদর্শ দার্শনিক জল্পনা কল্পনার মতই ওরিয়েন্টদের মত বস্তুগত হয়েছিল এবং এগুলোই ছিলো খ্রিষ্টানদের আধ্যাত্মিক ধর্মের সেই তিনটি ঐতিহাসিক উপাদান। এগুলো দিয়েই তারা বিশ্বজুড়ে ছড়ি ঘুরিয়েছিল।

এইসব উপাদানের উপর ভিত্তি করেই রোমানরা একটি নৃশংস কাজ করেছিল। তারা তখন প্যাগান দেবতাদের ব্যর্থতার আসনে তাদের নতুন আবিষ্কৃত ঈশ্বরকে স্থান দেয়। তারা এটি পেরেছিল কারণ তাদের হাতে তখন প্রায় পুরো পৃথিবী ছিল। এজন্য তারা প্রথম এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে পেরেছিল। এটি নিঃসন্দেহে মানবতার জন্য বেশ বাজে ও নেতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তারা একজন ঈশ্বরকে এভাবে তৈরি করলো যিনি জাতীয়তা, বস্তুগত ও সামাজিকতা ও সকল দেশের উর্ধ্বে। কখনো কখনো এই ঈশ্বর মানুষকেও অস্বীকার করেন। এই ঈশ্বর পুরোপুরিভাবে অশরীরী ও বিমূর্ত সত্তা।

সর্বোপরি গ্রিক দর্শনের হাতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি ও অগ্রগতির মাধ্যমে দার্শনিক পদ্ধতিতে পবিত্র জগতের ধারণা প্রতিষ্টিত হয়েছিল। এ মডেলটি চিরন্তনভাবে সৃজনশীল এবং দৃশ্যমান জগতে সর্বদা বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু যে পবিত্রতা গ্রীকদের থেকে গৃহীত ও প্রস্তুত করা হয়েছিল তা ছিল ব্যক্তি নিরপেক্ষ পবিত্রতা। কোন যৌক্তিক বা আধ্যাত্মিক দর্শনের পক্ষে একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা গ্রহণ বা বর্জন করা যায় না। তাই একজন একক ও একান্ত ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে কল্পনা করা সময়ের দাবি হয়ে উঠলো। অবশেষে এই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় ইহুদীদের জাতীয় ঈশ্বর হিসেবে, সেই নৃশংস, স্বার্থপর এবং ক্ষুদ্ধ ব্যক্তি জিহোবায়। এজন্য স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা থাকা সত্ত্বেও ইহুদীরা এ যুগে এসেও নিজেদের আলাদা করে রেখেছে। ইহুদীদের মধ্যে ব্যবসা করার প্রবণতা অনেক আগে থেকেই ছিল। ধীরে ধীরে এটি তাদের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যই হয়ে যায়। এই ব্যবসায়ীরা সারা পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। এর সাথে তারা জিহোবার উপাসনাও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা যত বেশি ঈশ্বরের কাছে নিজেদের উৎসর্গ করেছে, ঈশ্বর তাদের ততটাই বর্জন করে গেছেন।

আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রীকদের সেই স্কুলে ইহুদীদের এই ঈশ্বর প্লেটোর পবিত্রতার সাথে পরিচিত হন। তারই পরম্পরা হিসেবে একসময় জন্ম হয় তেজহীন খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরের। অর্থাৎ আলেকজান্দ্রিয়ার নব্য প্লেটোনিক বোদ্ধারাই ছিলেন খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের প্রধান ¯্রষ্টা।

তবুও ধর্মতত্ত্ব কখনোই একা কোনো ধর্মের জন্ম দিতে পারে না। এজন্য ঐতিহাসিক নানান উপাদানের প্রয়োজন। মাঝে মধ্যে ঐতিজাসিক উপাদানের চেয়েও বেশি কিছু দরকার পড়ে। ঐতিহাসিক উপাদান বলতে আমি কোনো বাস্তব অগ্রগতির সাধারণ অবস্থাকে বুঝাচ্ছি। উদাহরণ হিসেবে রোমানদের দ্বারা সমগ্র বিশ্বজয়ের অথবা ইহুদীদের ঈশ্বরের সাথে গ্রিকদের পবিত্রতার আদর্শের সাক্ষাতের কথা বলা যায়। ঐতিহাসিক উপাদানগুলোকে উর্বর করতে হলে একটি জীবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত সত্য প্রয়োজন। এই সত্যটি খ্রিষ্টান ধর্মে উপস্থিত ছিল। আর তা ছিল যীশুখ্রিষ্টের প্রচারণা এবং তার শহীদী পরিণতি! এটিই এই ধর্মের ঐতিহাসিক উপাদানকে ত্বরান্বিত করেছিল।

আমরা এই মহান ও সাধু ব্যক্তিটির সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না। গসপেলগুলো (খ্রিষ্টের বাণী সমূহ) এতই স্ববিরোধী যে সেখানে আমরা কেবল তার কয়েকটি গুণই খুঁজে পাই। সেখানে তার আসল মুখোশ আবিষ্কার করা বড্ড কঠিন। তবে এটা ঠিক যে তিনি গরিব বন্ধু ছিলেন। সেই সাথে একজন ধর্মপ্রচারক, হতভাগ্য, অশিক্ষিত, দাস ও নারীদের সান্ত¦নাদাতা আরো অনেক উপাধি তাকে দেয়া যায়। মূলত এসব কারণেই সবাই তাকে ভালোবাসত। তিনি বঞ্চিত, নির্যাতিত ও সংগ্রামীদের চিরন্তন জীবনের কথা শুনিয়েছিলেন। তাকে তৎকালীন দাপ্তরিক ও রাজকোষের প্রতিনিধিরা ফাঁসি দিয়েছিল। কিন্তু ফাঁসি দিলেও পৃথিবীতে তিনি অনেক শিষ্য রেখে গিয়েছিলেন। তার শিষ্য ও শিষ্যের শিষ্যরা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশ বিদেশে। তারা গসপেলগুলোকে সেসময় বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দিয়েছিল। এই প্রচারকেরা একটি কারণে ধন্যবাদ পেতে পারেন। তাদের কারণেই তখন রোমানদের জাতীয় শৃঙ্খলটি তারা ভেঙে গিয়েছিল। রোমান সা¤্রাজ্যের সর্বত্র তখন ক্রীতদাস ও নারীরা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার ছিল। এজন্য তারা গসপেলগুলো মুক্তভাবে গ্রহণ করেছিল। ধীরে ধীরে গসপেলগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রোমান সা¤্রাজ্যের নির্যাতিত মানুষজনও সচেতন হতে থাকে। এটিই ছিলো প্রলেতারিয়েতদের প্রথম সতর্ক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিদ্রোহ মানুষকে নতুন একটি দাসত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
খ্রিষ্টধর্মের এই অভূতপূর্ব ও বৈধ ধারাবাহিক বিজয়ের মহত্ত্ব, অকাট্য যোগ্যতা ও গোপনীয় বিষয়টি লুকিয়ে আছে সাধারণ মানুষের কাছে তার ব্যাপক আবেদনের কারণে। অন্যথা এটি ছড়াতে পারতো না। যারা মতবাদটি ছড়িয়েছিল তারা মনে করতো এটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে খুবই বিপ্লবী ও যৌক্তিক। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। সাধারণ সহজ, সরল, অশিক্ষিত ও দুর্বলচিত্তরা একে আদরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু জ্ঞানী ও বিজ্ঞবানেরা একে বর্জন করেছিল। সাধারণ মানুষের এই খ্রিষ্টীয় অযৌক্তিকতা মেনে নেওয়াটাই ছিল তাদের সবচেয়ে গভীর অপ্রাপ্তি, হৃদয়ের তৃষ্ঞা ও চিন্তার দারিদ্রতা। এর ফলেই এই খ্রিষ্টীয় অযৌক্তিকতাগুলো সকল ধৃষ্টতা ও পৈশাচিকতায় অন্য সকল ধর্মকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে এটি কিভাবে সম্ভব হলো? এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রত্মতাত্ত্বিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অস্বীকৃতির সৃষ্টি হয় নি। এটি মানুষের সাধারণ জ্ঞান ও কার্যকারণে অনীহার জন্যে সম্ভব হয়েছিল। এটিই মানুষকে ধীরে ধীরে গভীর শূণ্যতা ও চরম স্থায়িত্বের দিকে নিয়ে গেছে।

এই অসহনীয় ও অযৌক্তিক কাজকর্ম, পলের রচিত আখ্যান, বোকাদের নির্বুদ্ধিময় বিজয়ের কাহিনী এসব তখন এক এক করে জনসাধারণকে গেলানো হয়। একজন সৎ ও সত্যান্বেষী ব্যক্তির কাছে এই বিজয়ের কাহিনীগুলো সব সময়ই ক্লান্তিকর, দুর্নীতিগ্রস্থ, মোহহীন ও বিরক্তিকর ছাড়া কিছুই মনে হয় না।

অধ্যায়ঃ চার

বর্তমানে অনেককেই সম্মোহনবিদ্যা, আধ্যাত্মিকতা এরকম হাস্যকর বিষয়ে বিশ্বাস করতে দেখা যায়। খ্রীষ্টধর্ম, ভাববাদ কিংবা ঈশ্বরে বিশ্বাস- সবই এরকম হাস্যকর। আমরা যদি আদিকালের প্রলেতারিয়েতদের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তাদের বিশ্বাস ছিল দৃঢ় এবং সরল। অনেকটা আধুনিক যুগের মতই। খ্রিষ্টীয় অতিরঞ্জনত্ত্ব তাদের হৃদয় চেয়েছিল, মন নয়। প্রলেতারিয়েতরাও তখন তাদের অভাব, দুঃখকষ্ট এবং দাসত্বের কারণ চায় নি। যে কারণে প্রলেতারিয়েতরা এই অযৌক্তিক খ্রিষ্টধর্মের যৌক্তিক স্ববিরোধিতা ও অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারে নি। এর ফলে প্রলেতারিয়েতরা খ্রিষ্টধর্ম কখনো বুঝতেই পারে নি। তারা ধর্মান্তরিত হয়ে কেবল এর সংখ্যাই বাড়িয়েছিল, আধ্যাত্মিক শক্তিটিও বাড়ায় নি। অন্যদিকে ধর্মীয় মতবাদ হওয়ার কারণে খ্রিষ্টধর্মকেও তার স্ববিরোধীতা ও অস্তিত্ব নিয়ে সেসময় তেমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নি।

খ্রিষ্টীয় মতবাদ অনুসারে প্রলেতারিয়েতরা ধর্মান্তরিত হয়েছিল ব্যাপক তত্ত্বীয় ও সাহিত্যিক কাব্যকর্মের ফলাফল হিসেবে। একাজটি প্রধানত করেছিল ওরিয়েন্টের ধর্মান্তরিত নব্য প্লেটোনিকরা। ওই সময় গ্রিকদের পতন এতটাই মর্মান্তিক ছিল যে, খ্রিষ্টযুগের চতুর্থ শতকে প্রথম কাউন্সিলের সময় চার্চের ফাদাররা সর্বসম্মতভাবে সর্বশ্রেষ্ট, শুদ্ধ, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে এই খ্রিষ্ট্রীয় ঈশ্বরকে মেনে নিয়েছিলেন। এই চরম নির্বুদ্ধিতার ধারাবাহিকতা হিসেবে মানবাত্মার অশরীরীতা ও অমরত্বকে বিশ্বাস করা স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

খ্রিষ্ট ধর্মের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য যে, তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল ক্রীতদাসের পৃথিবীর সাথে। আরেকটি বড় ভাগ্য ছিল বর্বরদের বহিরাক্রমণ। বর্বররা ছিল মূল্যবান, প্রাকৃতিক শক্তিতে ভরপুর এবং জীবনের প্রয়োজন মেটানোর তাড়না ও সাধ্য তাদের ছিল। তারা তাদের উত্তরসূরী জার্মানদের মতোই লুুটেরা দস্যু ছিল। তারা যখন যা ইচ্ছা ধ্বংস করত, চুরি করতো। তারা জার্মানদের চেয়ে কম শৃঙ্খল, গোঁড়া, কম নীতিবাদী ও অশিক্ষিত ছিল। অপরদিকে তারা জার্মানদের চেয়েও বেশি মাত্রায় স্বাধীনচেতা, অহংকারী এবং বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলো (অনেকটা আধুনিক জার্মান বুর্জোয়াদের মতো)। কিন্তু এত কিছুর পরেও তারা ছিলো ¯্রফে বর্বর। একারণে প্রাচীন দাসদের ধর্মতত্ত্বীয় ও অধিবিদ্যাগত সকল অভিন্ন প্রশ্নই এই বর্বর জাতিতেই রয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোনো ভাবে তাদের এই বর্বরতা ও হিং¯্রতা থেকে বের করে আনা গেলে তাদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করাটা খুব বেশ সহজ ছিল। তৎকালীন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকেরা এই কাজটি সফলভাবে করতে পেরেছিলেন।

খ্রিষ্টীয় যুগের দশম শতক পর্যন্ত চার্চ ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে কোনো বিরোধকারী ছিল না। তারা ইউরোপকে কলুষিত, হীন চরিত্র ও কলঙ্কিত করেছিল। চার্চের বাইরে চিন্তাবিদ বা শিক্ষিত লোক না থাকার কারণে কেউ চার্চের সাথে প্রতিযোগিতাও করতে পারে নি। চার্চ একাই চিন্তা করতো, কথা বলতো ও লিখতো, একাই মানুষকে শেখাতো। যদিও তখন পৃথিবীর বুকে বুকে কিছু বক ধার্মিক জন্ম নিয়েছিল, কিন্তু এই বক ধার্মিকেরা কেবল এই মতবাদের ধর্মতত্ত্বীয় বা ব্যবহারিক অগ্রগতিতে আক্রমণ করতো। আর কোথাও তারা কিছু করতে পারে নি। তারা ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা ও বিশ্বের ¯্রষ্টায় বিশ্বাস এবং আত্মার অশরীরীত্বে বিশ্বাস- এই বিষয়গুলোকেও আক্রমণ করে নি। ফলে বিশ্বাস জিনিসটি পরবর্তীতে ইউরোপের পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের আদর্শ বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়। এটি সকল প্রতিষ্ঠান, সকল শ্রেণীর ব্যক্তিগত ও জনজীবনে প্রবেশ করে নিজের আসল মূর্তি ধারণ করে।

অবাক হওয়ার বিষয় এই যে, এই বিশ্বাস আজো টিকে আছে। মাজ্জিনি, মিশেলেট, কুইনেট সহ অনেকে এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তবে এই সুদীর্ঘ সময়ে ধর্মের উপর যে কেউ আঘাত হানে নি বিষয়টা এরকম ছিল না। ধর্মের উপর প্রথম আঘাতটি করে দুটি জিনিস। একটি ছিল রেঁনেসা এবং আরেকটি মুক্তমনা মানুষেরা। পঞ্চদশ শতকে ভানিনি, লিওর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিওর মতো বীর শহীদেরা ধর্মের উপর আঘাত হেনেছিলেন। যদিও সংস্কারের নামে গন্ডগোল, দাঙ্গা ও আবেগের কারনে তাদের সেই আত্মত্যাগ চাপা পড়ে গিয়েছিল, তবুও রেঁনেসা তখন নীরবে সকলের অলক্ষ্যে তার কাজটি করে যাচ্ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অযৌক্তিকতাকে ধ্বংস করার জন্য মানবতার মুক্তির মহান দায়িত্বটি প্রতিটি প্রজন্মের মহতী মানুষদের হাতে অর্পণ করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এই রেঁনেসা আবারও হাজির হয়। তবে এবার তার বলিষ্ট হাতে ছিল নাস্তিকতা ও বস্তুবাদের পতাকা।

মানুষের মন তখন সকল পবিত্র বিভ্রান্তির থেকে মুক্তি পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ তা আর সম্ভব হলো না। খ্রিষ্ট ধর্ম আর পবিত্র মিথ্যাচার তখন আরেকবার দৃশ্যপটে এসে হাজির হয়। এবার তাদের হাতে না আছে কৃষ্ঞাঙ্গ উপজাতি, না আছে চার্চের কাছে পবিত্র হওয়া ডাকাত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের। ফলে অপেশাদার যাজক, মিথ্যাবাদীদের নিকট খ্রিষ্টধর্ম ছড়ানোর দায়িত্ব আসে। এসময় এ ধর্মপ্রচারের মূলনীতি প্রণয়নে দুজন ভয়ংকর মানুষের অবদান ছিল। এদের মধ্যে একজন আঠারো শতকের সবচেয়ে বড় মিথ্যুক জাঁ জ্যাক রুশো এবং আরেকজন স্বৈরাচারী মতবাদের প্রবক্তা রোবেসপিয়ের।

রুশো ছিলেন সংকীর্ণতা ও সন্দেহ প্রবণতার জলন্ত উদাহরণ। তিনি অন্যদের চেয়ে কেবল নিজেরই উচ্চাকাংখা নিয়ে সচেতন থাকতেন। ভন্ডামিতে কখনো ভাবালু ও কখনো নির্মম। সর্বোপরি তিনি আধুনিক ভাববাদের প্রচারক ছিলেন। তাকে আধুনিক প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃত ¯্রষ্টা হিসেবেও দেখা হয়। আঠারো শতকের সবচেয়ে গণতন্ত্রমনা এই লোকটি সর্বত্র তার নির্লজ্জ কূটনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের বীজ ছড়িয়ে গিয়েছিলো। এরপর তার যোগ্য ও বিশ্বস্ত শিষ্য হিসেবে রোবেসপিয়ের তার প্রচারিত মতবাদের সর্বোচ্চ যাজক হবার চেষ্টা করেছিলেন। “যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকে, তাকে আবিষ্কার করো”- ভলতেয়ারের বাণিটি শুনে রুশো একেশ্বরবাদীদের জন্য একজন মহান, বিমূর্ত ও বন্ধ্যা ঈশ্বর আবিষ্কার করেছিলেন। এই অদ্বিতীয় ঈশ্বরের নামে তার অদ্বিতীয় সত্ত্বা ও কুটিল ধর্মের জন্য রোবেসপিয়ের অনেক কুকর্ম করেছিলেন। তিনি গিলোটিনে হেবার্টিস্টদের শিরোশ্চেদ করেছিলেন। এরপর শিরশ্চেদ করেন ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে বড় মেধা দান্তনকে। দান্তনকে হত্যার মধ্য দিয়ে রোবেসপিয়ের তখন গণতন্ত্রকেও হত্যা করেছিলেন। এভাবেই মূলত প্রথম বোনাপার্টের একনায়কত্বের বিজয়ের পথ সুগম হয়েছিলো। এই বিশাল বিজয়ের পরে ভাববাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের কাজের সুযোগ অনেক বেড়ে যায় । ফ্রান্সের শ্যাতুব্রিয়াঁ, ল্যামার্ত, এমনকি ভিক্টর হুগোও এই ভাববাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দলে ছিলেন। এদের সামনে রেখেই দুঃখভারাক্রান্ত আবেগী দরিদ্ররা জার্মানিতে স্থাপন করেছিল একটি আধুনিক রোমান্টিক স্কুল। এই স্কুলের সৃষ্টি হওয়া সাহিত্যগুলো ছিল উদ্ভট ধরনের। প্রকাশ্য দিবালোকে এর কোনো জায়গা ছিলো না। গোধূলিই ছিলো এ সাহিত্যের উপযুক্ত স্থান। জনগণের সাথে ন্যূনতম যোগাযোগও ছিলো না এর। এটি ছিল আবেগ প্রবণ, অভিজাত, অসাধারণ আত্মা এবং স্বর্গলোভীদের সাহিত্য। যেন কেবল এদেরই পৃথিবীতে বাঁচার কথা! দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্ন ও রাজনীতিকে এরা ভয়ে এড়িয়ে যেত। যখনই কেউ এদের দিকে আঙুল তুলতো তখন এরা মুক্তমনাদের বিপক্ষে অন্যদিকে চার্চের পক্ষে সুর তুলতো। জনগণের বদলে রাজার পক্ষ নিতো এবং আমজনতার বিরুদ্ধে অভিজাতদের সাফাই গাইতো। এই স্কুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রোমান্টিকতা। রাজনীতি সম্পর্কে এদের জ্ঞান ছিল একেবারে অসম্পূর্ণ।
রেঁনেসা ও বিপ্লব চলাকালীন সংস্কারের সময় থেকে বুর্জোয়ারাই ছিল ইতিহাসের বিপ্লবী প্রতিভার নায়ক ও দূত। জার্মানিতে না হলেও ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডে বিষয়টি এরকমই ছিল। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চদশ শতকের মুক্তচিন্তক, পরপর দুই শতাব্দীর ধর্মীয় সংস্কারক, মানবতার মুক্তির অগ্রদূত, এমনকি তৎকালীন জার্মান বিপ্লবীদের কথাও বলা যায়। এদের সবাই-ই বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত ছিল। ১৭৮৯ ও ১৭৯৩ এর বিপ্লব দুটি এরকমই ছিল। এই বিপ্লব দুটির বিপ্লবীরাও বুর্জোয়া ছিল। তবে জনগণের শক্তিশালী অংশই ছিল এই বিপ্লবীদের সমর্থক। এই বিপ্লবীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তারা রাজতন্ত্র ও চার্চতন্ত্রের পতন সক্ষম হবেই। তারা তখন জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার এবং মানুষের অধিকার আদায়ের আহ্বান জানায়। এগুলোই ছিলো তাদের বিপ্লবের মূল্যবান কীর্তি!

কিন্তু তাড়াতাড়িই তাদের এ কীর্তি বিভক্ত হয়ে যায়। জাতীয় সম্পদের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ তখন বিত্তশালী হতে থাকে এবং প্রলেতারিয়েতদের প্রতি পৃষ্টপোষকতা বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে ফ্রান্সের কৃষকদের যারা ততদিনে জমির মালিকানা পেয়ে গেছে তারা তখন সরকারি কাঠামোর পুণঃপ্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী স্বাভাবিক সরকার ব্যবস্থা স্থাপন করার দাবি জানাতে থাকে।

প্রথম বোনাপার্টের একনায়কতন্ত্র কৃষকদের এই দাবির প্রতি সাধুবাদ জানায়। ভলতেয়ারের অনুসারী হয়েও বোনাপার্ট তখন পোপের সাথে চুক্তি করেন এবং সরকারের সাথে ফ্রান্সের দাপ্তরিক চার্চতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি বাণী দিলেন- “জনগণের জন্য ধর্ম খুব দরকার।” তার মানে, নিজেদের তৃপ্ত করে বুর্জোয়াদের এই অংশটি তাদের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন বুঝত পারলো এবং সদ্যপ্রাপ্ত ভূসম্পত্তি সংরক্ষণের চেষ্টা করলো যাতে স্বর্গীয় প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জনগণের অতৃপ্ত শুধাকে নিবৃত্ত করা যায়। এরপরই আগমণ ঘটলো আরেক প্রচারকের, শ্যাতুব্রিআঁ।

ধীরে ধীরে প্রথম বোনাপার্টের পতন হয় এবং সংস্কারের মাধ্যমে ফ্রান্সে বৈধ রাজতন্ত্র ফিরে আসে। এর পেছনে ছিল চার্চ ও নানা মহান ব্যক্তিদের শক্তি। এ ঘটনাটি বুর্জোয়াদের আবারো বিপ্লবের রাস্তায় নিক্ষেপ করলো। পুণঃজাগরণ হয় সংশয়বাদ ও বিপ্লবী চেতনার। বিপ্লব এবার শ্যাতুব্রিআঁকে ফেলে ভলতেয়ারকে অনুসরণ করা শুরু করলো। এসময় দিদেরুর মতবাদও বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি। এর নিস্তেজ ¯œায়ু এত আদর যতœ সহ্য করতে পারে নি। অন্যদিকে ভলতেয়ার, একই সাথে মুক্তচিন্তক ও যৌক্তিক একেশ্বরবাদী হয়েও এর সাথে মানিয়ে নিলেন। বেরাঙ্গার ও পি এল কুরিয়ার এসম্পর্কে যথার্থই বলেছেন- “ভাল মানুষের ঈশ্বর ও আদর্শ বুর্জোয়া রাজা।”
১৮৩০ সালের জুলাইয়ের বিপ্লব বুর্জোয়াদের স্বাদে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। আমরা জানি, এর আগে প্রতিটি ফরাসি বুর্জোয়া তাদের মধ্যে ভদ্রতার অবিনশ্বরতা বহন করতো, যা কেবল ভুইফোঁড় সম্পদশালী ও শক্তিমান লোকদের মধ্যে থাকত। ১৮৩০ সালের পর সম্পদশালী বুর্জোয়ারা শক্তিমত্তার আসনগুলোতে এ পুরনো মহত্ত্বকে বিসর্জন দেয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন একটি নতুন অভিজাত তন্ত্রের উদ্ভব হয়। প্রথমত এটি ছিল পুঁজির অভিজাততন্ত্র। সেই সাথে বুদ্ধিজীবী, শিষ্টাচার ও আবেগেরও অভিজাততন্ত্র বটে। এটি ধর্মের স্বাদকে পুণরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

এই পরিবর্তনটি কেবল অভিজাত প্রথার অন্ধ অনুকরণেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। এটি নিজের প্রয়োজনের তাগিদেই তৈরি হয়েছিল। প্রলেতারিয়েতরা মহৎ লোকদের (!) ভূপাতিত করার জন্য এ পরিবর্তনকে মেনে নিলো। প্রলেতারিয়েতদের তখন বুর্জোয়াদের আর কোনো সহায়তার প্রয়োজন থাকলো না। ফলে জনসাধারণ তখন বুর্জোয়াদের জন্য অসুবিধাজনক হতে শুরু করলো। এই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তখন অভিজাততন্ত্রকে পুণঃপ্রেরণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু জনগণের মধ্যে ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ জাগিয়ে তোলা ছাড়া এটি করা সম্ভব ছিলো না। এই ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ তাহলে কীসের নামে হবে? বুর্জোয়াদের স্বীকৃত স্বার্থের নামে? কিন্তু এটা বিদ্রুপমূলক হয়ে যেত। তখন তারা ধর্মকে বেছে নেয়। সর্বকালের সেরা বুর্জোয়া বিজয়ীরা দেখলো যে, ধর্মই হলো মানুষের একমাত্র অপরিহার্য অংশ।

ধর্মীয়, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার গর্বময় মুকুট পরার পরে আন্দোলন এবং বিপ্লবকে পরাজিত করে এই অভিজাত বুর্জোয়ারাই একাধারে প্রভাবশালী, রাষ্ট্রের রক্ষক ও প্রহরী হয়ে উঠলো। একচেটিয়া শক্তি প্রদর্শনের জন্য তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তো ছিলই। এভাবেই রাষ্ট্রের দ্বারা তখন জনগণের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা হয়েছিল।

রাষ্ট্রের হাতে তখন জনগণকে প্রভবিত করার দুটি প্রক্রিয়া ছিল। প্রথমটি বাস্তব ও মেনে নেয়া কঠিন- কারণ এটি রাষ্ট্রকে বাতিল করে দেয়। অন্যকথায়, বললে সংখ্যালঘুদের দ্বারা সংখ্যাগুরুদের প্রতিষ্টিতি রাজনৈতিক শোষণকে এটি বাতিল করে দেয়। এজন্য ধর্মই তখন একমাত্র রাস্তা হিসেবে খোলা থাকে। এটি হলো এক ধরনের চিরন্তন মরীচিকা; যা জনগণকে পবিত্র গুপ্তধনের সন্ধানে ব্যস্ত রাখে।

ফরাসি স্বাধীনচেতা ও ভলতেয়ারপন্থী বুর্জোয়ারা সংকীর্ণ ও নৃশংস দৃষ্টবাদী মেজাজের ছিল। ১৮৩০ সালের বিজয়ের পর তারা শাসকশ্রেণীতে পরিণত হয়। নির্ধারিতভাবেই তারা দাপ্তরিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে। কাজটি খুব সহজ ছিলো না। একদিকে তারা রোমান ক্যাথলিকবাদের ছায়াতলে আর ফিরে যেতে পারছিল না, অন্যদিকে বুর্জোয়া ও রোমান চার্চের মাঝে ছিলো অতল ঘৃণা ও রক্তপাত। শেষ পর্যন্ত ক্যাথলিকবাদে পুণর্গমণ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এক্ষেত্রে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ অনেক সুবিধাজনক ছিল। এটি তখন শ্রেষ্ট বুর্জোয়া ধর্ম হয়ে ওঠে। বুর্জোয়াদের কাছে এটি যথেষ্ট সুবিধাজনক ছিলো, কারণ এটি স্বর্গীয় আকাঙ্খার সাথে পার্থিব চাহিদা ও পরিস্থিতি সম্মিলন ঘটিয়েছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলোতে শিল্প ও বাণিজ্য উন্নত হতে লাগলো। কিন্তু ফরাসি বুর্জোয়াদের পক্ষে প্রোটেস্ট্যান্ট হওয়া সম্ভব ছিল না। ফরাসি বুর্জোয়াদের একচ্ছত্র দৃষ্টবাদী মনে বিশ্বাস বলে কোনো বস্তু ছিল না। তারা মুক্ত কণ্ঠে তাদের অনাসক্তি প্রকাশ করতো। তাদের কাছে প্রোটেস্ট্যান্ট বা ক্যাথলিকবাদ অভিন্ন ছিল। তাছাড়া ফরাসি জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্যাথলিক ধর্ম ত্যাগ করে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়াটাও তাদের জন্য একটা অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল।

দ্বিতীয় উপায়টি ছিল আঠারো শতকের মানবতাবাদী ও বিপ্লবী ধর্মে ফিরে যাওয়া। কিন্তু সেটির মেয়াদ ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই বুর্জোয়াদের হাতে রাষ্ট্র গঠনের একটিমাত্র পথই খোলা ছিল- নতুন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা! যেখানে হাস্যকর ও কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলো থাকবে না এবং সবকিছুই তাদের কথামতো চলবে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম হয় যৌক্তিক একেশ্বরবাদের।

এই যৌক্তিক একেশ্বরবাদের জন্ম ও অগ্রগতি তৎকালীন ফরাসি তরুণ বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শিক্ষার উপর চূড়ান্ত ও মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল। এই মতবাদের প্রকৃত প্রবর্তক ছিলেন রয়্যার কোলার্ড। গুইজোট, কাজিন, ভিলেমাইন সহ অনেকেই এর প্রচারের সাথে যুক্ত ছিলেন। সর্বোপরি বেনজামিন কনস্ট্যান্ট থেকে মাদাম ডি স্টলের সময় পর্যন্ত এর দারুণ প্রভাব ছিল। এই মতবাদের স্বীকৃত উদ্দেশ্য ছিল প্রতিক্রিয়ার সাথে বিপ্লবের মিলন সাধন করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে এই মতবাদের প্রচারকেরা তাদের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বকে ব্যবহার নানান সুবিধা আদায় করেছিল। বিপ্লবের সাথে প্রতিক্রিয়াকে মেলাতে গিয়ে তারা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা হরণ করেছিল। দার্শনিকভাবে বিশ্বাসের চিরন্তন নীতিকে মুক্তভাবে উপস্থাপন করেছিল।

এই দর্শনের অন্যতম প্রচারক এম. কাজিন একজন অগভীর নীতিবাগিশ বক্তা ছিলেন। প্রকৃত ধারণা গ্রহণে তিনি পুরোপুরি অক্ষম ছিলেন। এমনকি নতুন কোনো ধারণাও মেনে নিতে পারতেন না। এগুলোর তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যই ছিল বলা যায়। এই প্রসিদ্ধ দার্শনিক ফরাসি পড়–য়া তরুণদের জন্য এমন একটি খাদ্য তৈরি করলেন যা পরবর্তীতে বাধ্যতামূলকভাবে ফ্রান্সের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলানো হয়। চার্চের ফাদার, বিদ্যান দার্শনিক দেকার্ত, প্যাস্কেল, কান্ট এবং স্কটিশ মনোবিজ্ঞানীদের সাথে প্লেটো এবং হেগেলীয় সর্বেশ্বরবাদের মত, পবিত্র ও সহজাত ধারার মিশ্রণ সব মিলে তিনি এক ধরনের জগাখিচুরি তৈরি করেছিলেন। এভাবেই যৌক্তিক একেশ্বরবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিলেন! এটি “দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ” এর মত মুর্খ তত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।

Idioma: 

Seccion: 

Tipo de contenido: